
কুশল দাসগুপ্ত, (শিলিগুড়ি)
আর পাঁচটা মহিলার মতো স্বামী-সন্তান নিয়ে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিলে কেউ–ই হয়তো আপত্তি করত না। শিলিগুড়ির প্রধাননগরের বাসিন্দা তানিয়া দত্তর জীবনটা শুরু হয়েছিল সেভাবেই। স্বামী বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করেন। থাকেন কলকাতায়। শিলিগুড়িতে সন্তানকে নিয়ে থাকেন তানিয়া। কিন্তু গড়পড়তা জীবন তো সকলে চায় না। অন্তত তানিয়া তেমন একটা জীবন চাননি, চেয়েছিলেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে।
কয়েক দিনের একটা প্রশিক্ষণ নিয়ে বাড়িতেই শুরু করেছিলেন বার্থ–ডে কেক তৈরি। প্রথমে প্রতিবেশীদের খাওয়াতেন। যাঁদের দিয়েছেন তাঁরাই প্রশংসা করেছেন। কিছুদিনের মধ্যে তিনিও বুঝে যান যে তাঁর হাতে জাদু রয়েছে। ফলে পাকাপাকি ভাবে নেমে পড়েন ব্যবসায়। সেই কেক এখন এতটাই জনপ্রিয় যে শিলিগুড়ির প্রধাননগরের ‘ক্রিমি ক্রিয়েশন’ এখন রাজ্যের নামজাদা কেক প্রস্তুতকারক সংস্থাদেরও ঘোল খাইয়ে ছাড়ছে।

কেবল কোয়ালিটিতেই নয়, কেকের গড়পড়তা দামেও। আগে শিলিগুড়িতে বার্থ–ডে কেক পাঁচশো টাকার নীচে ভাবাই যেত না। এখন আড়াশো-তিনশো টাকাতেও ভালো মানের কেক পাওয়া যায় তানিয়ার সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে। তার পরেও প্রতিদিন তানিয়ার দোকান থেকে গড়ে বার্থ–ডে কেকই বিক্রি হয় প্রায় দু’শো পাউন্ড। ভ্যালিনা, চকোলেট, ব্ল্যাক ফরেস্ট কী নেই সেই সম্ভারে। উৎসবের মরশুমে কেকের উৎপাদন ডাবল হয়ে যায়। তাঁর কেক কিনতে কেবল শহরের মানুষই নন, সিকিম, নেপাল, ভুটান থেকেও ক্রেতারা হাজির হন প্রধাননগরে।

আগে লোকে কেবলমাত্র জন্মদিনেই কেকের অর্ডার দিত। তানিয়ার হাতযশে এখন বিয়েতেও কেক কাটা হচ্ছে। ব্যাঙ্ক কিংবা বেসরকারি হাসপাতালের অনুষ্ঠানেও কেকের অর্ডার হচ্ছে। তার পরেও রয়েছে প্যাটিস, ক্রিম রোল থেকে নানা রকমারি বেকারি সামগ্রী। দোকানের মাথায় তৈরি ছোট্ট একটা ক্যাফেটোরিয়া। ২০১৮ সালে কেক তৈরি শুরু করেছিলেন। ছয় বছরের মধ্যে জীবন যে এতটা ব্যস্ত হয়ে পড়বে সেটা যে তিনি ভাবতেই পারেননি, সে কথা অস্বীকার করেন না। তিনি বলেছেন, ‘আগে সময় কাটতে চাইত না। বাচ্চা মানুষ করা ছাড়া তেমন কোনও কাজ তো ছিল না। এখন দম ফেলার সময় নেই। ছেলেকে স্কুলে পাঠিয়েই শুরু হয় ব্যবসার নানা কাজ।’

তানিয়ার ব্যবসার আয়তন কেবল কেকের পরিমাণ দিয়েই বোঝা সম্ভব নয়। সারাদিন ধরে বার্থ–ডে কেক ও অন্যান্য বেকারি সামগ্রী তৈরি, ক্যাফে পরিচালনা, কারখানা সামলানোর জন্য তানিয়ার সঙ্গে এখন যোগ দিয়েছেন চোদ্দ জন কর্মচারী। কোনও রকম সরকারি কিংবা ব্যাঙ্ক ঋণ ছাড়াই কারখানার জন্য প্রায় ৪২ লক্ষ টাকার মেশিনারি কিনেছেন। প্রথম দিকে তানিয়ার স্বামী ছুটিতে শিলিগুড়িতে এসে স্ত্রীকে সাহায্য করতেন। কেক ডেলিভারি দিতে নিজেই ছুটতেন।
দু’বছর হলো স্ত্রীকে সাহায্য করতে স্বামী মৃত্যুঞ্জয় দত্ত চাকরি ছেড়ে শিলিগুড়িতে ফিরে এসেছেন। এখন স্বামী-স্ত্রী মিলে সারাদিন ব্যবসা সামলান। মৃত্যুঞ্জয় বলেন, ‘এই ব্যবসা গড়ে তোলার পিছনে আমার তেমন কোনও অবদান নেই। পুরো কৃতিত্বই আমার স্ত্রীর। আমি নেহাতই সাহায্যকারী। তবে মনে হয় আমরা একদিন অনেক উপরে যাব। জানিয়ে দিলেন তিনি।