
“বিসর্জন”
সৌমেন মুখোপাধ্যায়

“না বৌমা, এই কলিকালে বাপ বেটাকে বিশ্বাস করে না আবার আমার কথা বিশ্বাস নাও হতে পারে। নাহলে ঐ পাড়ার হুকো মহন্তকে নয় জিজ্ঞেস করে নিও। অসময়ে শত্রুও মিত্র হয়। তাই বললাম। ” আবার পানের পিচ ফেলে দেখলো ঝর্ণাদেবীর কাছ থেকে কোন উত্তর না পেয়ে আবার বলতে থাকে, “না মা, এইবেলায় উঠি, সন্ধ্যার সময় আসবো । বাড়ীতে কত কাজ, ঝি টা শুদ্ধ কাজে আসে নাই, সব কাজ একা সামলাতে হচ্ছে। তখনকার মেয়েগুলো তাও কিছু কাজ করতো এখনকার মেয়েগুলো কিছু করে কিনা সন্দেহ। না মা উঠছি। হাঁ যাবার সময় আবার বলে রাখছি, কতটা সত্যি না মিথ্যা। হরি নারায়ণ, হরি নারায়ণ।” এই বলে দাওয়া থেকে উঠে মুখ থেকে পানের শেষ পিচটা ফেলে কাপড়ের খুঁট থেকে আর একটা পান মুখে পুড়ে দিয়ে তার গন্তব্যস্থলের দিকে এগিয়ে যায়। বুড়ি চলে যাওয়ার পর ঝর্ণাদেবীর কানে বিশেষ কথাগুলো বারবার বাজতে থাকে। প্রচন্ড রাগে আবার দরজায় করাঘাত আর চিৎকার করতে থাকে। যখন সমস্ত চেষ্টা বৃথা গেল তখন ঝর্ণাদেবী ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
ঘরের দরজা যেমন বন্ধ ছিল ঠিক তেমনি বন্ধ রইল একবারও কপাটের একটা ভাঁজও খুলল না। সন্ধ্যা থেকে রাত হয়ে গেল, তবুও ঝর্ণাদেবী ফিরল না। রাতের প্রহর কেটে ভোরের আলোয় পাখীদের কলরব শোনা গেল, তখন দরজার পাল্লা আসতে আসতে খুলল। একসময় শিউলী ঘর থেকে বেরিয়ে আসে, চুলগুলো এলোমেলো, চোখে মুখে চিন্তার ছাপ, মেঝেতে কাপড়ের আঁচল লুটিয়ে পড়ে আছে। চৌকাঠ পেরিয়ে শিউলী মায়ের খোঁজ করে। সারাঘরময় মায়ের কোন চিহ্ন দেখতে না পেয়ে পাগলের মতো ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামে। প্রত্যেকের ঘর থেকে হতাশ হয়ে ফিরে যখন পুকুরঘাট দিয়ে বাড়ী যাবার সময় পুকুরঘাটে ভিড় দেখে থমকে দাঁড়ায় শিউলী। সন্দেহের বশে ভিড় ঠেলে এগিয়ে যায়, যা দৃশ্য দেখলো তাতে সে অবাক হয়ে যায়, তার মা । তার মায়ের দেহটা পুকুরঘাটের সিড়িতে শোয়ানো আছে, শেষ নিঃশ্বাসটা কখন ছেড়েছে তা কেউ জানে না। মায়ের বুকের উপর শিউলী আছাড় খেয়ে পড়ে “মা” বলে একবার ডাক দেয় তারপর অজ্ঞান হয়ে যায়। জ্ঞান ফেরার পর শুনতে থাকে সমস্ত লোকের কাছ থেকে নানারকম কটুক্তি। সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করে নেয়।