কুশল দাশগুপ্ত, শিলিগুড়ি:
গত বিধানসভা ভোটের ফলাফলে পিছিয়ে থাকলেও পরবর্তীতে উত্তরবঙ্গে তৃণমূলের বিধায়ক সংখ্যা বিজেপি-কে ছাপিয়ে গিয়েছে। সামনের বছরই আবার নির্বাচন আসছে। এখন থেকেই সে দিকেও আলাদা নজর রয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। সোমবার উত্তরবঙ্গ সফরের প্রথম দিনেই শিল্পবৈঠক থেকে তা স্পষ্ট হয়ে গেল।
শিলিগুড়ির দীনবন্ধু মঞ্চে উত্তরবঙ্গের শিল্পোদ্যোগীদের সঙ্গে বৈঠক করলেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রত্যেক জেলার ব্যবসায়ীদের অভাব-অভিযোগ দীর্ঘক্ষণ শুনলেন। মঞ্চে বসেই কিছু সমস্যার সমাধানও খুঁজে দিলেন। একাধিক প্রকল্পের উদ্বোধন করলেন। আর উত্তরবঙ্গে বড় অঙ্কের সরকারি বিনিয়োগের ঘোষণাও করে দিলেন।
২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের পাশে দাঁড়ায়নি উত্তরবঙ্গের প্রায় ৬০ শতাংশ কেন্দ্র। কিন্তু তার পর থেকে প্রায় প্রত্যেক নির্বাচনেই উত্তরে তৃণমূলের ফলাফল আগের তুলনায় ভাল হতে থেকেছে। ২০২৬ সালের নির্বাচনে উত্তরের কাছ থেকে আরও দরাজ সমর্থন চাইছেন মমতা।
আরও পড়ুন: উত্তরবঙ্গে ৫৪ আসনে জেতার দাবি বিরোধী দলনেতার
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে সারা রাজ্যে ধাক্কা খেয়েছিল শাসকদল। শূন্য হয়ে গিয়েছিল উত্তরবঙ্গে। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে দক্ষিণবঙ্গে বিজেপিকে পুরোপুরি ধরাশায়ী করে দেয় তৃণমূল। কিন্তু উত্তরে তৃণমূল পিছিয়েই ছিল। উত্তরবঙ্গের ৫৪টি বিধানসভা আসনের মধ্যে ৩০টিতে বিজেপি জিতেছিল। কিন্তু তার পর থেকে উত্তরে তৃণমূলের পরিস্থিতি ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করে। বিধানসভা নির্বাচন মেটার পরে দিনহাটা বিধানসভা আসন থেকে বিজেপির নিশীথ প্রামাণিক পদত্যাগ করার পর যে উপনির্বাচন হয়, তাতে রেকর্ড ব্যবধানে তৃণমূলের উদয়ন গুহ জেতেন। পরে রায়গঞ্জ, ধূপগুড়ি এবং মাদারিহাট বিধানসভার উপনির্বাচনেও জেতে তৃণমূল। ফলে এই মুহূর্তে উত্তরবঙ্গে তৃণমূলের বিধায়ক সংখ্যা বিজেপির চেয়ে বেশি।
উত্তরবঙ্গে পরিকাঠামোর উন্নয়নে অনেক আগে থেকেই প্রস্তুতি শুরু করেছিলেন মমতা। সোমবার শিল্প বৈঠকের মঞ্চ থেকে তিনি কাজ সম্পূর্ণ হওয়া বেশ কয়েকটি প্রকল্পের ভার্চুয়াল উদ্বোধন করলেন। তার মধ্যে রয়েছে জলপাইগুড়ির জল্পেশ মন্দিরের প্রবেশপথে পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত স্কাইওয়াক, শিলিগুড়িতে বেসরকারি আবাসিক স্কুল, পশ্চিমবঙ্গ ক্ষুদ্রশিল্প উন্নয়ন নিগমের উদ্যোগে জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ারে তৈরি হওয়া চারটি শিল্প উদ্যান। এ ছাড়াও উদ্বোধন করেন শিলিগুড়ির ওয়েবেল আইটি পার্কে ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগে তৈরি হওয়া তথ্যপ্রযুক্তি ক্লাস্টারের। জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, রায়গঞ্জ, মালদহ-সহ উত্তরবঙ্গের ছয় শহর থেকে মঙ্গলবারই দিঘা যাওয়ার জন্য বাতানুকূল বাস পরিষেবা চালু হচ্ছে বলেও মুখ্যমন্ত্রী সোমবার ঘোষণা করেন।
আগামী দিনের জন্য একগুচ্ছ ঘোষণাও করেছেন মমতা। মুখ্যমন্ত্রী জানান, কোচবিহারে শিল্প উদ্যান গড়বে সরকার। কলকাতায় (নিউটাউনে) যেমন আন্তর্জাতিক মানের কনভেনশন সেন্টার তৈরি করা হয়েছে, তেমন একটি পরিকাঠামো দিঘাতেও হয়েছে। এ বার ওই মানের কনভেনশন সেন্টার তিনি শিলিগুড়িতেও তৈরি করতে চান বলে মমতা ঘোষণা করেন। সেখানে হোটেলও থাকবে বলে তিনি জানান। যাতে সেখানে কোনও অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসা প্রতিনিধিরা চাইলে থেকেও যেতে পারেন। বৈঠক চলাকালীনই আধিকারিকদের সঙ্গে কথা বলে মুখ্যমন্ত্রী সেই কনভেনশন সেন্টারের জন্য জমি চিহ্নিত করে ফেলেন। তিনি জানান, উত্তরায়নের উল্টো দিকে ১০ একর জমি রাখা হচ্ছে ওই কনভেনশন সেন্টারটি তৈরি জন্য। উত্তরায়নের কাছেই পাঁচ একরের অন্য একটি জমিতে শিল্প উদ্যান বা অন্য কোনও ধরনের কর্মসংস্থান কেন্দ্র গড়ার পরিকল্পনা করতেও প্রশাসনকে তিনি নির্দেশ দেন। বাগডোগরা বিমানবন্দরের উল্টো দিকে সরকারের হাতে চার একর জমি রয়েছে বলে জানতে পেরে সেখানে হোটেল তৈরির প্রস্তাব দেন মুখ্যমন্ত্রী। বিমানবন্দরের আশেপাশে যেহেতু তেমন কোনও হোটেল নেই, তাই ওই জমি তিনি হোটেল তৈরির জন্য রেখে দিতে বলেন
আরও পড়ুন: উত্তরবঙ্গ-দিঘা প্রতিদিন ছুটবে ৬টি ভলভো বাস, বিজনেস সামিটে জানালেন মুখ্যমন্ত্রী
বিভিন্ন জেলার শিল্পোদ্যোগী তথা ব্যবসায়ী সমিতির প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে মুখ্যমন্ত্রী বেশ কিছু অভিযোগ পান। তার মধ্যে বেশ কয়েকটির সমাধানের নির্দেশও তৎক্ষণাৎ দিয়ে দেন। কোচবিহারের ব্যবসায়ীরা অভিযোগ তুলেছিলেন যে, ওই জেলায় ট্রেড লাইসেন্স পাওয়ার খরচ এই মুহূর্তে রাজ্যে সবচেয়ে বেশি। যে দোকানের মিউটেশন (নামপত্তন) করতে আগে দু’হাজার টাকা লাগত, এখন সেই মাপের দোকানের মিউটেশনের জন্য পাঁচ লক্ষ টাকা নেওয়া হচ্ছে বলে ব্যবসায়ী সমিতির তরফ থেকে জানানো হয় মুখ্যমন্ত্রীকে। জঞ্জাল অপসারণ (কনজ়ারভেন্সি ফি) খাতেও পুরসভা আগের চেয়ে বেশি টাকা নিচ্ছে বলে মুখ্যমন্ত্রীকে জানানো হয়। এই ঘটনা জেনে তৎক্ষণাৎ স্থানীয় প্রশাসনের কাছে জবাব চান মমতা। তিনি বলেন, ‘‘আমি তো বাড়াতে বলিনি। আমি সব সময় কর বাড়ানোর বিরুদ্ধে। পারলে আমি কর মকুব করে দিই। জলের করও আমরা নিই না। এখানে বাড়ানো হয়েছে কেন?’’ মুখ্যসচিবকে তিনি নির্দেশ দেন স্থানীয় প্রশাসনের জবাব চাইতে। অবিলম্বে ওই বর্ধিত মাশুল কমানোর নির্দেশও মুখ্যমন্ত্রী দিয়ে দেন।
চা শিল্পকে চাঙ্গা করতেও রাজ্য সরকারের তরফ থেকে সব রকম সহযোগিতার আশ্বাস মুখ্যমন্ত্রী দিয়েছেন। এক নামী চা উৎপাদক সংস্থার কর্ণধারের দেওয়া প্রস্তাব মুখ্যমন্ত্রীর পছন্দ হওয়ায় তিনি দ্রুত সব বাগান মালিককে ওই বিষয় নিয়ে আলোচনায় বসতে বলেছেন। অবিলম্বে সব বাগান মালিককে ডেকে প্রস্তাবটি নিয়ে আলোচনার দায়িত্ব মুখ্যমন্ত্রী ওই নামী সংস্থার কর্ণধারকেই দিয়েছেন। দার্জিলিঙের বাগান মালিকদের পাশে দাঁড়িয়ে রাজ্য সরকার অন্য একটি দেশ থেকে আসা ‘ভেজাল মেশানো’ চায়ের উপরে বিধিনিষেধ আরোপ করতে চলেছে বলেও মুখ্যমন্ত্রী সোমবার জানিয়েছেন। কোনও দেশের নাম তিনি করেননি। তবে জানিয়েছেন, ওই দেশ থেকে আসা চায়ে ভেজাল থাকায় দার্জিলিং চায়ের নাম খারাপ হচ্ছে। তাই এ বার থেকে রাজ্যে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ওই চায়ের গুণমান পরীক্ষা করে নেওয়া হবে। রাজ্য সরকার তার জন্য পরীক্ষাগার তৈরি করছে বলে মুখ্যমন্ত্রী জানান।
মালদহ জেলার ব্যবসায়ীরা মাখনার উপর থেকে কৃষি বিপণন কর তুলে নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী ওই কর প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়েছেন।
মঙ্গলবার জলপাইগুড়িতে সরকারি পরিষেবা প্রদানের একটি কর্মসূচিতে উপস্থিত থাকবেন মমতা। বুধবার শিলিগুড়িতে উত্তরবঙ্গের আট জেলাকে নিয়ে প্রশাসনিক বৈঠক। বৃহস্পতিবার মমতা কলকাতায় ফিরে আসবেন।