দালাল স্ট্রিটে গত এক মাসের হিসাব বলছে, প্রায় ১৮ শতাংশ দাম পড়েছে টেলিকম পরিষেবা সংস্থা ভোডাফোন-আইডিয়ার। এক সময় যে সংস্থার শেয়ার ছুটেছে ১০০ টাকার গন্ডিতে, তা আজ সমস্ত শৌর্য খুইয়ে এসে ঠেকেছে ৬ টাকায়। পরিস্থিতি এতটাই কঠিন যে সংস্থার কর্তৃপক্ষ নিজে থেকে বলতে হচ্ছে যে এই ভাবে চলতে থাকলে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে হবে তাদের।
আরও পড়ুন: সতর্কতা জারি! উঠেছে ঝড়, ‘ব্ল্যাকআউট’ পৃথিবীর নানা প্রান্তে! ছিটকে বেরোচ্ছে আগুনের গোলা
কিন্তু এককালে ‘জুজু’ দেখিয়ে মানুষের মন জয় করা ভোডাফোন, হঠাৎ করেই আজ নিজের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের পথে কেন হাঁটছে? উত্তর দিতে পারে সংস্থার সেকাল-একাল।
সাল ১৯৮৪। বিশ্বজুড়ে হওয়া প্রযুক্তি বিপ্লবের হাত ধরে ব্রিটেনের বুকে জন্ম নেয় টেলিকম পরিষেবা সংস্থা ভোডাফোন। যে কোনও আবির্ভাব মানুষের মনে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে সময় নেয়। ভোডাফোনের ক্ষেত্রে সেই একই তত্ত্বই প্রযোজ্য হয়। গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে সময় নেয় তারা। এই ভাবে কেটে যায় ৯০-এর দশক।
২০০০ সাল থেকে ভরা জোয়ার দেখতে পায় ভোডাফোন। ব্রিটেনের গন্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে বিস্তীর্ণ ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়া মহাদেশে। ভারতে আসে ২০০৭ সাল নাগাদ। আর একটা বিজ্ঞাপনেই কেরে নেয় মানুষের মন। কারণ ভোডাফোনের সেই বিজ্ঞাপনের মূল কেন্দ্র ছিল একটি কুকুর। যা ভারতীয় বিশেষ করে দাগ কাটে গ্রামীণ এলাকায় বসাবসকারী মানুষদের মনে। সেই সময় ভোডাফোন নিজেদের বিজ্ঞাপনে যে স্লোগান ব্যবহার করেছিল তা হল, ‘যেখানে যাবে, আমাদের নেটওয়ার্ক সঙ্গে যাবে।’
সঙ্গে এল। তবে বেশিদিন নয়। তাই তো ২০২৫ সালের পাততাড়ি গোটানোর কথা বলছে ভোডাফোন। যে ‘জুজু’ দিয়ে এতদিন তারা মজাদার বিজ্ঞাপন বানিয়েছে। সেই ‘জুজুই’ যেন এবার ঋণ দৈত্ব হয়ে তাদের ঘাড়ে চেপে বসেছে।
২০০৭ সালে যখন ভোডাফোন ভারতে আসে, সেই সময় Hutchison Essar সংস্থার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশীদারিত্ব কিনে নেয়। মাথায় বসে অরুণ সারিন। তার নেতৃত্বেই আগামী ১২ বছরে কয়েক গুণ বৃদ্ধি হয় এই টেলিকম পরিষেবা সংস্থার। ওই সময়কালে Hutchison Essar-এর কাছে ব্রিটিশ ভোডাফোনের ভারতে ৬৭ শতাংশ অংশীদারিত্ব ছিল। যার তৎকালীন মূল্য ছিল ১ হাজার কোটি মার্কিন ডলার।
একদিকে যখন ব্যবসায়ীক স্তরে অন্য মাত্রা ছুঁয়ে যাচ্ছে ভোডাফোন। তৈরি করছে জনমানসে বিশ্বাস। সেই একই সময়েই ধীরে ধীরে আবার নানা আইনী জটেও জড়িয়ে পড়ছিল তারা। চড়া শুল্ক, ভারী প্রতিদ্বন্দ্বীতা, স্পেকট্রামের আকাশছোঁয়া খরচ। সব মিলিয়ে একটু একটু করে জটে জড়িয়ে পড়ছিল ভোডাফোন।
এই ব্রিটিশ টেলিকম সংস্থার আগমনের কালেই তৎকালীন মনমোহন সিং সরকার অন্যান্য টেলিকম পরিষেবা সংস্থাগুলিকেও ভারতে আসার জন্য একটা ‘মুক্তাঞ্চল’ তৈরি করছিল। নিমিষে মিলে যাচ্ছিল টেলিকম পরিষেবা চালানোর লাইসেন্স। যার জেরে বাজারে বাড়ছিল প্রতিদ্বন্দ্বি। ভোডাফোন নিজের তরী ধরে রাখলেও, তখন থেকেই একটু একটু করে চাপ বাড়ছিল তাদের উপর।
আরও পড়ুন: কলকাতার আকাশে রহস্যময় ড্রোন! সামনে এল ভারতীয় সেনার বক্তব্য
এরপরই ২০১১ সালে ২জি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারি। ২০১২ সালে সুপ্রিম কোর্টে মামলা। যেখানে ভোডাফোন অভিযুক্তদের তালিকায় না থাকলেও, এই ঘটনার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছিল তাদের উপরেও। বেড়েছিল নিয়ন্ত্রণ, নানা আইনি জটিলতায় পড়তে হয় তাদের। বাড়তে থাকে খরচ। এমনকি, যে ২জি স্পেকট্রাম তারা অল্প দামে তুলেছিল। মামলার কারণে সেই স্পেকট্রামকেই আবার বাড়তি টাকা দিয়ে কিনতে হয় ভোডাফোনকে।
২০১২ সালের এই ক্ষতি যখন ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠছে ভোডাফোন। ঠিক চার বছরের মাথায় ঘটে মুকেশ অম্বানির টেলিকম সংস্থা রিলায়েন্স জিও-র অকাল বোধন। বাজারে জিও-র আগমনটা অন্য সকল টেলিকম পরিষেবা সংস্থাকে রীতিমতো বিপদের মুখে ফেলবে, সেই ইঙ্গিত আগেই দিয়েছিলেন বিশেষজ্ঞরা। তেমনটাই হল। ২০১৬ সালে জিও-র বিনামূল্যে ১ জিবি ইন্টারনেট আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ফাঁকা করে দিল প্রতিদ্বন্দ্বিদের। বাজার থেকে মুছে গেল একেরপর এক টেলিকম পরিষেবা সংস্থা। মুছে যাওয়ার পর্যায়ে এসে, ২০১৮ সালে হাত মিলিয়ে নিল ভোডাফোন-আইডিয়া।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জিও-র আক্রমণের থেকে ভোডাফোনের কাছে চাপের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল, যে সময় ‘আক্রমণ’ চালিয়েছে তারা। ২০১৬ সালে নিজেদের নেটওয়ার্ক এককেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়া চালাচ্ছি ভোডাফোন। যার জন্য অনেক টাকা খরচ পড়েছিল তাদের। আর সেই সময়ই বিনামূল্যের ঝোলা নিয়ে চলে আসে জিও।
একদিকে আকাশছোঁয়া প্রতিদ্বন্দ্বিতা। অন্যদিকে, টিকে থাকা লড়াইয়ের জেরে বাড়তে থাকা ঋণের বোঝা। যত না আয়, তার চেয়ে বেশি ব্য়য়। সম্প্রতি প্রকাশিত ভোডাফোন-আইডিয়ার শেষ ত্রৈমাসিকের রিপোর্ট বলছে, গত তিন মাসে তাদের লোকসান হয়েছে প্রায় ৬ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। তবে এই পরিসংখ্যা তাদের কাছে আশার। কারণ, ঠিক এক বছর আগে শেষ ত্রৈমাসিকে তাদের ক্ষতি হয়েছিল ৬ হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা এবং তৃতীয় ত্রৈমাসিকে ক্ষতি হয়েছিল ৭ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা।
দিন দিন বাড়তে থাকা লোকসানের জেরে বিপুলের করের বোঝা চেপেছে এই টেলিকম সংস্থার ঘাড়ে। বর্তমানে AGR বকেয়া অনুযায়ী, তাদের উপর ঋণের বোঝা রয়েছে প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকার অধিক। সোমবার সুপ্রিম কোর্টে এই ঋণ মকুবের আর্জিতে দ্বারস্থ হয়েছিল তারা। তারও আগে গিয়েছিল গিয়েছিল ন্যাশনাল কোম্পানি ল ট্রাইব্যুনালের কাছে। সেখানে ভোডাফোন কী বলে?
তাদের দাবি, অবস্থা খুবই সঙ্গীন। সরকার পাশে না দাঁড়ালে কয়েক বছরের মধ্যেই ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে হবে। কিন্তু সরকার কি পাশে দাঁড়াচ্ছে না? মাস কতক আগেই ভোডাফোন আইডিয়ার ৩৬ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা ঋণকে অংশীদারিত্বে পরিণত করেছে কেন্দ্র। কিন্তু তারপরেও সরকারের কাছে ঋণ মকুবে দাবি জানাচ্ছে ভোডাফোন। বিশেষজ্ঞরা বলছে, সরকার যদি এই ভাবে ঋণের পরিবর্তে অংশীদারিত্ব নিয়ে নেয়, তাহলে শেয়ারে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাবে খোদ ভোডাফোন কর্তৃপক্ষই। যা কার্যত সম্ভব নয়।