ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রথম সারির অন্যতম যোদ্ধা হিসেবে উঠে আসে বিনায়ক দামোদর সাভরকরের নাম। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে তাঁকে জীবনের ১১ বছর কাটাতে হয়েছিল দ্বীপান্তরে। সকলের থেকে আলাদা করে সাভারকরকে রাখা হয়েছিল কালাপানির সেলুলার জেলে।
জন্ম ও বংশ পরিচয়
১৮৮৩ সালের ২৮ মে মহারাষ্ট্রের নাসিকের ভগুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বিনায়ক দামোদর সাভরকর। তাঁর মা ছিলেন রাধাবাই সাভারকর এবং পিতা ছিলেন দামোদর পন্ত সাভারকর। রাধাবাই এবং দামোদর পন্ত সাভারকরের চার সন্তান ছিল, তিন ছেলে এবং এক মেয়ে। বিনায়ক দামোদর সাভারকর প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন নাসিকের শিবাজি স্কুলে। তিনি শৈশব থেকেই ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনে লিপ্ত হন। ১১ বছর বয়সে মাঙ্কি আর্মি গঠন করেন তিনি। পরে স্বদেশি আন্দোলনে যোগ দেন তিনি।
আরও পড়ুন: “আপনিই সেই BSF জওয়ান না?” পূর্ণমকে দেখেই চিনে গেল তারকেশ্বরের পুরোহিত
হিন্দু শব্দের সংজ্ঞা দিয়েছিলেন সাভারকর
আন্দামানের কুখ্যাত সেলুলার জেলে নিজের কুঠুরিতে বন্দি বিনায়ক দামোদর সাভারকর কারাগারেই রচনা করেছিলেন ‘হিন্দু’ শব্দের সংজ্ঞা। এর ফলে ‘হিন্দু’ কে? যুক্তিসম্মত, প্রাসঙ্গিক ব্যাখ্যা পেয়েছিল দেশবাসী। সাভারকরের ভাষায়,
‘‘আ সিন্ধু, সিন্ধু পর্যন্তা যস্য ভারত ভূমিকা পিতৃভূ, পূণ্যভূশ্চৈব সবৈ হিন্দু রিতি স্মৃত’’
অর্থাৎ, সিন্ধু নদ থেকে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত এই বিশাল ভূখণ্ডকে যিনি পূণ্যভূমি ও পিতৃভূমি বলে মনে করেন, তিনি আস্তিক হতে পারেন, নাস্তিক হতে পারেন, প্রতিমাপূজক অথবা নিরাকারবাদীও হতে পারেন, তিনিই হিন্দু। কোনও ব্যক্তি যদি ভারতীয় পরম্পরা, ঐতিহ্য, কৃষ্টিকে মেনে চলেন তিনিই হিন্দু। হিন্দু শব্দের ব্যাপকতা তাই ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ভারত-ভূমির সংস্কৃতি এবং জাতীয়তাবোধের নামই হিন্দুত্ব।
লোকমান্য তিলকের দর্শন তাঁকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল
সাভারকর ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী, রাজনীতিবিদ, আইনজীবী এবং লেখক ও দার্শনিক। ‘হিন্দু মহাসভা’-তেও সাভারকর ছিলেন একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব। হাইস্কুলের ছাত্র থাকাকালীনই সাভারকর স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ শুরু করেন বলে জানা যায়। পুণের ফার্গুসন কলেজে পড়াশোনা করতেন তিনি। লোকমান্য তিলকের দর্শন তাঁকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল। ব্রিটেনে আইন পড়তে যান তিনি। সেখানে পড়াশোনা করার সময় ইন্ডিয়া হাউস এবং ফ্রি ইন্ডিয়া সোসাইটির মত স্বাধীনতাকামী দলগুলির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।
আরও পড়ুন: শক্তি বাড়িয়ে উপকূলের দিকে এগোচ্ছে নিম্নচাপ, বুধেই ভারী থেকে অতিভারী বর্ষণ শুরু দক্ষিণবঙ্গে
ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন
১৯০৫ সালে দশেরার দিনে বিদেশ থেকে নিয়ে আসা সমস্ত জিনিসপত্র এবং কাপড় পোড়ানো শুরু করেন সাভারকর। এরপর আইন নিয়ে পড়তে লন্ডন পাড়ি দেন সাভারকর। কিন্তু ব্রিটিশদের ঘরে থেকে তাঁদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কৌশল রপ্ত করতে থাকেন তিনি। গঠন করেন অভিনব ভারত সোসাইটি, ফ্রি ইন্ডিয়া সোসাইটি নামে দুই সংগঠন। ১৯১০ সালে তাঁকে লন্ডনে গ্রেফতার করা হয়। নাসিকের জেলা কালেক্টর জ্যাকসনকে হত্যার জন্য নাসিক ষড়যন্ত্র মামলার অভিযোগে ১৯১১ সালের ৭ এপ্রিল কালাপানির সাজা দেওয়া হয় বিনায়ককে। ১৯১১ সালের ৪ জুলাই থেকে ১৯২১ সালের ২১ মে পর্যন্ত পোর্ট ব্লেয়ার জেলে ছিলেন তিনি।
স্বাধীনতার জন্য সমুদ্রে ঝাঁপ
সাভারকরকে যখন লন্ডন থেকে ভারতে আনা হচ্ছিল তখন তিনি ব্রিটিশদের হাত থেকে পালানোর জন্য এসএএস মোরিয়া জাহাজের শৌচালয়ের জানলা দিয়ে ভূমধ্যসাগরের ঠান্ডা জলে ঝাঁপ দেন। মৃত্যুভয় তাঁর ছিল না। শুধু স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাবেন বলে যে কোনও উপায়ে তিনি মুক্তির চিন্তা করেছিলেন। ভূমধ্যসাগরের দীর্ঘ জলপথ সাঁতরে তিনি ফরাসি উপকূলে পৌঁছেছিলেন। চেয়েছিলেন আশ্রয়। কিন্তু ব্রিটিশ বিরোধিতায় রাজি হয়নি ফ্রান্স। তাঁরা সাভারকরকে ইংরেজদের হাতে তুলে দেয়। এরপর তাঁর ঠিকানা হয় আন্দামানের সেলুলার জেল। যেখানে অন্ধকারে চলে নির্যাতন। কিন্তু জেল থেকেও স্বাধীনতার জন্য কবিতা-প্রবন্ধ লিখতে থাকেন তিনি। স্বাধীনতার জন্য চলে তাঁর নিরলস সংগ্রাম।