Wednesday, 9 July, 2025
9 July, 2025
Homeরাজ্যJyoti Basu: জ্যোতি বসুই বলতে পেরেছিলেন, দিল্লির পার্টি অফিসে আলো জ্বলে পশ্চিমবঙ্গের...

Jyoti Basu: জ্যোতি বসুই বলতে পেরেছিলেন, দিল্লির পার্টি অফিসে আলো জ্বলে পশ্চিমবঙ্গের কমরেডদের চাঁদার পয়সায়

প্রয়াত সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক ইয়েচুরি একবার স্বীকার করেন, তিনি জ্যোতি বসুর বিরুদ্ধে ভোট দিয়ে ভুল করেছিলেন। তিনি বলেন, কংগ্রেস নেতা অর্জুন সিংজি আমাকে এর জন্য কোনওদিন ক্ষমা করবেন না, আমি জানি।

অনেক কম খরচে ভিডিও এডিটিং, ফটো এডিটিং, ব্যানার ডিজাইনিং, ওয়েবসাইট ডিজাইনিং এবং মার্কেটিং এর সমস্ত রকম সার্ভিস পান আমাদের থেকে। আমাদের (বঙ্গবার্তার) উদ্যোগ - BB Tech Support. যোগাযোগ - +91 9836137343.

জ্যোতি বসু। ভারতের হাতে গোনা কয়েকজন রাজনীতিকের একজন, যিনি জীবদ্দশায় তো বটেই, মৃত্যুর ১৫ বছর পরেও সমান আলোচিত। কিছু তোষামুদে তারিফ, কিছু নিন্দা, বহু সমালোচনার অভিঘাত পেরিয়েও জ্যোতি বসু জাতীয় রাজনীতিতে এমন এক ব্যক্তিত্ব, যাঁর সঙ্গে অন্যের তুলনা টানা খুবই কঠিন কাজ। কট্টর কমিউনিস্ট পার্টির আজীবন সদস্য থেকেও বিলাতি শিক্ষা ও আধুনিক মনস্কতার কারণে তিনি এদেশে দলকে উদারতন্ত্রের পথে পরিচালিত করেছেন। কখনও কোনও আচরণে একগুঁয়েমির দ্বারা গোঁড়ামির রাজনীতি করেননি। তাই অনেক ক্ষেত্রে রাজ্যের অধিকার রক্ষার লড়াইকে যেমন এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন, তেমনই পুঁজিবাদী, বুর্জোয়া দল কংগ্রেস সম্পর্কেও অনড় থাকেননি। সে কারণে দলের ভিতরেই কম সমালোচনা সহ্য করতে হয়নি তাঁকে। একদা যে পলিটব্যুরোতে দক্ষিণী লবির বাড়বাড়ন্ত হয়েছিল, যারা কট্টরপন্থী মনোভাবে বিশ্বাসী ছিল। শোনা যায়, সেইসব গোঁড়া মার্কসবাদীদের নাম না করে জ্যোতি বসুই বলতে পেরেছিলেন, দিল্লির পার্টি অফিসে আলো জ্বলে পশ্চিমবঙ্গের কমরেডদের চাঁদার পয়সায়।

আরও পড়ুন: জ্যোতি বসুর স্মৃতিচারণে গৌতম; “ইচ্ছে ছিল সার্বভৌম গণতান্ত্রিক দেশ গড়ার”

জ্যোতি বসু অহঙ্কারী, নাক উঁচু, গম্ভীর, কম কথার মানুষ, সমাজের নিচুতলার মানুষের সঙ্গে মেশেন না, ব্যক্তিত্বের এমন একটা বজ্রকঠিন বলয় তৈরি করে রেখেছিলেন, যাতে কেউ ধারেকাছে ঘেঁষতে সাহস করত না। এত কিছু নিন্দেমন্দ সহ্য করেও মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টিতে এমন এক সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন যে লালদুর্গ তাঁর জীবদ্দশায় কেউ ভাঙতে পারেননি। অথচ তাঁর মৃত্যুর একবছরের মাথাতেই সেই দুর্গ খোলামকুচির মতো ভেঙে পড়েছিল। এখানেই জ্যোতি বসুর নাম অশোকস্তম্ভের সিলমোহরের মতোই একীভূত হয়ে গিয়েছিল। অনেকেই তাঁকে বলেন, ক্ষমতালোভী, জমিদারি চালে চলা কমিউনিস্ট, পুত্রস্নেহে অন্ধ পিতা। কিন্তু, তাঁর অবসরের পর এখনও পর্যন্ত তাঁর সেই অগাধ সম্পত্তি কিংবা পুত্র চন্দন বসুর বেআইনি, বেনামি স্বর্ণখনির হদিশ মেলেনি। সেই আমলের প্রবল শত্রুদল কংগ্রেসের দোর্দণ্ডপ্রতাপ ইন্দিরা গান্ধীর সরকারও জ্যোতি বসুর অবৈধ সম্পত্তির কিংবা আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন অর্থের উৎস সন্ধানে প্রবৃত্ত হয়নি। তাঁর কিংবা পরিবারের বিরুদ্ধে কোনও ইডি-সিবিআই তদন্ত হয়নি। দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে মুখে মুখে, কিন্তু, তার জন্য তিহার জেলে ঢুকতে হয়নি। হাজিরা দিতে যেতে হয়নি ইডি-সিবিআই অফিসে। কমিউনিস্ট রাজনীতিতে তিনি ছিলেন এক সময়ের সঙ্গে হাত ধরে চলা নেতা। যে কারণে, কোনও সময় ইন্দিরা হটাও, রাজীব হটাও লড়াইয়ে অটলবিহারী বাজপেয়ীর হাতও ধরেছেন। আবার কখনও সাম্প্রদায়িক বিজেপিকে দূরে ঠেলে রাখতে নিজে প্রধানমন্ত্রী পদে বসতেও রাজি হয়েছিলেন। আবার সেই তিনিই লালকৃষ্ণ আদবানির রামরথকে ঠেকিয়ে গ্রেফতার করেননি। কারণ, তিনি সবথেকে ভাল যেটি বুঝতেন তা হল জনতার মন। জনগণের সঙ্গেই ছিলেন, তাঁদের মনে ছিলেন- নায়ক অথবা খলনায়কের রূপে। কিন্তু তিনি ছিলেন অবিনশ্বর হয়ে। জীবদ্দশায় তাঁকে বিনাশ করা যায়নি।
পশ্চিমবঙ্গে ২৩ বছর কমিউনিস্ট মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ‘রাজ’ করেছেন  জ্যোতিবাবু। তাঁর দলই তাঁকে ঐতিহাসিক ভুল করে প্রধানমন্ত্রী হতে দেয়নি। কিন্তু, এটাই দেশের ভিতরে ধুতি-পাঞ্জাবি পরা ধোপদুরস্ত বাঙালি ক্যারেক্টার জ্যোতি বসুর সমগ্র পরিচয় নয়। দলের কাজ শুরু করেছিলেন যখন, তখন ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের অধীন ভারতে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ। দলের আত্মগোপনকারী নেতাদের জন্য চাঁদা সংগ্রহ করতে রাস্তায় নেমেছিলেন বিলাতে আইন পাশ করা ধনী বাপমায়ের এই সন্তান। বিলাতে আইন পড়ে ফিরেছিলেন ১৯৪০ সালে। লন্ডনই ছিল ভারতীয় মার্কসবাদীদের আঁতুড়ঘর। ফলে যখন ফিরলেন তখন তাঁর চোখে সমাজ বদলের স্বপ্ন। সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার সংকল্প নিলেন।

১৯৪৪ সালের গোড়ার দিকে যোগ দিলেন নিষিদ্ধ সিপিআইয়ে। তাঁর এই কাজ বাড়ির লোকের মান্যতা পেল না। মিরাট চক্রান্ত মামলায় ১৯২৯ সালেই অবিভক্ত সিপিআই তখন নিষিদ্ধ। মুজফফর আহমেদ, এস এ ডাঙ্গে, এস ভি ঘাটে, ডঃ জি অধিকারী, পিসি জোশি, এসএস মিরাজকর, শওকত ওসমানি ও ফিলিপ স্প্র্যাটের মতো নেতারা জেলবন্দি। দেশজুড়ে কমিউনিস্টরা কারখানায় তালা ঝুলিয়ে হরতাল পালন করছেন ব্রিটিশরাজ ভারত ছাড়়। মহাত্মা গান্ধীর অহিংস পদ্ধতিতে নয়, প্রয়োজনে হিংসাত্মক বিপ্লবের চেষ্টা চলছে জায়গায় জায়গায়। জ্যোতি বসুর কাঁধে চাপল গুরুদায়িত্ব। আত্মগোপনকারী নেতাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা। আড়ালে-আবডালে চাঁদা সংগ্রহ করা। যাতে পার্টির কাজ চলতে পারে। ১৯৪৬ সালে জ্যোতি বসু রেলওয়ে এমপ্লয়িজ বিধানসভা ক্ষেত্র থেকে বিধান পরিষদের সদস্য হলেন। তার একবছর পরেই দেশ স্বাধীন হল, কিন্তু জ্যোতি বসু আর সংসদীয় রাজনীতির কক্ষচ্যুত হলেন না।

তারপর ১৯৯৬ সাল। ভারতীয় রাজনীতিতে এক কঠিন দুঃসময়। কংগ্রেসের প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসিমা রাওয়ের পতনের পর। কংগ্রেস মাত্র ১৪০টি আসনে আটকে গেল। বিজেপি পেল একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের মর্যাদা। তাদের মুঠোয় ১৬১ আসন। বিজেপি সরকার গঠনের দাবি জানিয়ে অটলবিহারী বাজপেয়ীকে মুখ করে ক্ষমতায় এল। ১৩ দিনের মাথায় পতন ঘটে সেই সরকারে। তখন সরকার গঠনের জন্য তৈরি হল সংযুক্ত মোর্চা। ভিপি সিং ও সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক হরকিষেন সিং সুরজিৎ প্রস্তাব দিলেন জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার। কিন্তু, দলের কেন্দ্রীয় কমিটি ২৭-২২ ভোটে সেই প্রস্তাব নামঞ্জুর করে দিল। ১৯৯৬ সালে এক সাক্ষাৎকারে জ্যোতি বসু এই সিদ্ধান্তকে ঐতিহাসিক ভুল বলে ব্যাখ্যা করেন। ২০০৪ সালেও এক সাক্ষাৎকারে ঐতিহাসিক ভুল বলে উল্লেখ করে কারণ ব্যাখ্যা করেন নিজেই। বলেছিলেন, ইতিহাস এই সুযোগ বারবার দেয় না। ফলে আমাদের দল যদি মোর্চা সরকারে যেত এবং আমি যদি একবছরের জন্যও প্রধানমন্ত্রী হতাম, তাহলে মানুষ পিছিয়ে পড়া শ্রেণির লোকদের বুঝতে পারত। অনেক জায়গার মানুষ এও জানে না, আমরা আসলে কে, কাদের প্রতিনিধি।

আরও পড়ুন: ‘৫০ বছরের বেশি বাংলায় কাটানোর পর নোটিস! NRC চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে’, বিচলিত মুখ্যমন্ত্রী

অনেক পরে অবশ্য কট্টর দক্ষিণপন্থীদের বোধোদয় হয়। সীতারাম ইয়েচুরি তাঁদের মধ্যে অন্যতম। প্রয়াত সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক ইয়েচুরি একবার স্বীকার করেন, তিনি জ্যোতি বসুর বিরুদ্ধে ভোট দিয়ে ভুল করেছিলেন। তিনি বলেন, কংগ্রেস নেতা অর্জুন সিংজি আমাকে এর জন্য কোনওদিন ক্ষমা করবেন না, আমি জানি। অনেকের বিশ্বাস, সেদিন জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ দিলে, আজ হিন্দুত্ববাদীদের এই রমরমা হতে পারত না। ধর্মের ভিত্তিতে দেশীয় রাজনীতির অগ্রগমন ঘটত না।
প্রাক্তন কূটনীতিক ও প্রাক্তন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধী ১৯৯৩ সালে জ্যোতি বসুর একটি স্মৃতিকথার উল্লেখ করেছিলেন। তখন গোপালকৃষ্ণ লন্ডনের নেহরু সেন্টারে ডিরেক্টর পদে কাজ করতেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ২০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে নিয়ে আসা হয়েছিল জ্যোতি বসুকে। তিনি মন দিয়ে ভাষণ গড়গড় করে পড়ে চলেছেন। দীর্ঘ সেই ভাষণে শ্রোতাদের অনেকেই ক্লান্ত-বিরক্তও। হঠাৎ ভাষণ থামিয়ে জ্যোতি বসু চশমার উপর দিয়ে তাঁদের একবার দেখে নিলেন এবং বললেন, দেখুন আমি কেবল এই ভাষণ পড়ছি। একজন বিশেষজ্ঞ এটা আমার জন্য লিখে দিয়েছেন। আমি নিজেও এতকিছু জানতাম না। পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমিও অনেক কিছু জেনে নিলাম। গোপালকৃষ্ণ লিখেছেন, শ্রোতাদের একজনও কেউ বাকি ছিলেন না, যিনি এই কথা শুনে হাততালিতে ফেটে পড়েননি।

দেশের বাম রাজনীতিতে বেশ কিছু লেখার লেখক আদিত্য নিগমের বক্তব্য অনুযায়ী, জ্যোতি বসু শুধু বিরাট মাপের নেতা বা জননেতা ছিলেন না। পণ্ডিত বলে খ্যাত জ্যোতি বসুর মধ্যে ছিল জনতার সঙ্গে খাপ খাওয়ানো এক অদ্ভুত সহজ-সরল অনুভূতি। ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডের ভাষণগুলিই তাঁর প্রমাণ। অন্য বাম নেতাদের মতো তিনি শ্রমিক-কৃষকের শৃঙ্খল ভাঙার শপথের ভাষণ দিতেন না। মানুষ বোঝেন, এমন সব কথা বলতেন। মনে হতো তিনি আর একজন কারও সঙ্গে গল্প করছেন। জনতার মস্তিষ্কে নয়, বুকের ভিতর ঢুকে যেত তাঁর কথা। তাঁর ভাষণে কখনও প্ররোচনা, উসকানি থাকত না। কোনও জটিল বাক্য বা শব্দও নয়। কারণ তিনি জানতেন, যাঁরা তাঁর কথা শুনতে এসেছেন, তাঁদের ঘরের ভাষাতেই তিনি তাঁদের ঘরে ঢোকার অনুমতি পাবেন। আর হয়েছিলও তাই। পার্টিকে সামনে রেখে বাংলার মানুষ জ্যোতি বসুকেই চোখের মণির মতো আগলে রেখে দিয়েছিল ২৩ বছর ধরে।

এই মুহূর্তে

আরও পড়ুন