Saturday, 13 September, 2025
13 September
বাংলা কাউন্টডাউন টাইমার
বঙ্গবার্তা
HomeবিনোদনBhanu Bandyopadhyay: দিনবদলের ইস্তেহার! বামপন্থা এসেছে সূক্ষ্ম অবয়বে; কমেডিকে অস্ত্র বানিয়ে তোলেন...

Bhanu Bandyopadhyay: দিনবদলের ইস্তেহার! বামপন্থা এসেছে সূক্ষ্ম অবয়বে; কমেডিকে অস্ত্র বানিয়ে তোলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়?

খিদে, বেকারত্ব, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন—সব মিলিয়ে লাল পতাকার নিশানের সঙ্গে আকৈশোরের সম্পর্ক।

অনেক কম খরচে ভিডিও এডিটিং, ফটো এডিটিং, ব্যানার ডিজাইনিং, ওয়েবসাইট ডিজাইনিং এবং মার্কেটিং এর সমস্ত রকম সার্ভিস পান আমাদের থেকে। আমাদের (বঙ্গবার্তার) উদ্যোগ - BB Tech Support. যোগাযোগ - +91 9836137343.

ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। নামটা উচ্চারণ করলেই আর সবকিছু ভুলে চোখের সামনে ভেসে ওঠে মুখভরা হাসি, বিদ্রুপে রঙিন, অথচ গভীরে লুকিয়ে তীক্ষ্ণ, মেধাবী আলো। তিনি বাংলা সিনেমার ইতিহাসে অনন্য কৌতুকশিল্পী। এই নিয়ে দ্বিমত থাকার জায়গা নেই।

কিন্তু আজ আমাদের প্রশ্নটা অন্য: সিনেপর্দায় যিনি ‘মজার অভিনেতা’, তিনি কি স্রেফ লোক হাসাতেই কমেডিকে অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন? নাকি সজ্ঞান-সংলাপে, অভিপ্রেত-অভিব্যক্তিতে পৌঁছে দিতে চাইতেন অন্যতর কোনও বার্তা? মনে করতেন কৌতুকও হতে পারে দিনবদলের হাতিয়ার?

আরেকটু সোজাসাপ্টা বললে, সওয়াল দাঁড়ায় এই: ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় কি ভাবধারায় আপাদমস্তক কমিউনিস্ট ছিলেন? নাকি কেবল বামপন্থার বাতাসে ভেসে যাওয়া এক মানুষ, যাঁর কাছে মতাদর্শ ছিল শিল্পের অবলম্বন? উত্তর খুঁজতে গেলে ফিরে তাকাতে হয় বিশ শতকের বাংলা, তার রাজনীতি, সাংস্কৃতিক অঙ্গন আর অবশ্যই ভানুর জীবনপথের দিকে।

আরও পড়ুনঃ ফেসবুকে ভিডিয়ো বানানোর নেশা! চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র পল্লব নস্করের মৃত্যু ঘিরে ধোঁয়াশা

শুরু মুরারীপুরে। ১৯২০ সালের ২৬ আগস্ট, পূর্ববঙ্গের সেই গ্রামে জন্ম নেওয়া সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায় পরবর্তী কালে হয়ে উঠলেন ‘ভানু’ বন্দ্যোপাধ্যায়। শৈশবেই নাটক, কবিতা, গান—সব কিছুর প্রতি অদম্য টান। ছাত্রাবস্থায় দেশভাগ, দাঙ্গা, তোলপাড় রাজনীতি ছুঁয়ে গেল তাঁকে। ঢাকার কলেজে পড়ার সময়ে তরুণ সাম্যময়ের বন্ধুবৃত্তে ছিল বিপ্লবী আবহ। রাইটার্সের অলিন্দ যুদ্ধে শহিদ দীনেশ গুপ্তর সঙ্গে হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। বিপ্লবীর জন্মদিনে রায়টার্সে যাওয়াটা ছিল অবশ্যকৃত্য। আজীবন তা পালন করেছেন। ছবিতে প্রণতি জানিয়ে, খানিক চুপচাপ দাঁড়িয়ে তারপর ফিরে আসা… কোনওদিন এর ব্যত্যয় হয়নি। সমাজতন্ত্রের আদর্শে দীক্ষিত ছিলেন বলেই হয়তো গর্ব করে বলতেন, ‘আমার মায়ের বাবা আমার নাম রেখেছিলেন সাম্যময়… আই অ্যাম আ কমিউনিস্ট, আই বেয়ার ইট ইন মাই নেম।’

খিদে, বেকারত্ব, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন—সব মিলিয়ে লাল পতাকার নিশানের সঙ্গে আকৈশোরের সম্পর্ক। পরে কলকাতায় এসে সেই ঝোঁক, সেই পূর্বস্মৃতি পেল নতুন আকার, নতুন রূপ। মহানগরীতে পা দিয়েই ভানু জড়িয়ে পড়লেন আইপিটিএ-র নাট্যচর্চায়। ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন, ১৯৪৩-এ গঠিত, তখন শিল্পমাধ্যমকে হাতিয়ার করে দুনিয়াবদলের গান গেয়ে চলেছে। ভানু মঞ্চে অভিনয় করলেন, কণ্ঠ মিলল গণসংগীতে। একসময়ের সহকর্মী, ‘পদাতিক কবি’ সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘IPTA আমাদের শিখিয়েছিল—মঞ্চ মানে কেবল আলো-ঝলকানি নয়, সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রাম। ভানু সেই বিশ্বাসে বাঁচত।’

এই সময়ের অভিজ্ঞতা তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলে। স্পষ্ট কমিউনিস্ট পরিচয় না থাকলেও, তাঁর চিন্তার কেন্দ্রে ছিল মানুষের সমানাধিকারের স্বপ্ন। বন্ধুদের মধ্যে অনেকে সক্রিয় পার্টিকর্মী। ভানু তাঁদের সঙ্গেই বৈঠক করেছেন, চলতে-ফিরতে কানে আসছে আলোচনার ঝাঁঝালো স্রোত। জহর রায় এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, ‘ভানু রাজনীতিকে রসিকতায় মিশিয়ে দিত। IPTA তাকে শিখিয়েছিল—হাসিও হতে পারে অস্ত্র।’

আরও পড়ুনঃ টেরাকোটা বিশ্বের দরবারে! বিশ্বমঞ্চে পাঁচমুড়ার টেরাকোটা

অতিরঞ্জিত স্তুতি? একেবারেই নয়। কথার পাশাপাশি কাজেও মতাদর্শকে লালন করেছেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। শিল্পীদের স্বার্থরক্ষায় তৈরি করেছেন সংগঠন। নিজের স্বার্থ ভুলে। ইন্দ্রপুরী স্টুডিয়োতে যখন ধর্মঘট হয়েছিল, কেরিয়ারের পরিণতির তোয়াক্কা না করে সামিল হন ‘সিনে টেকনিশিয়ান্স অ্যান্ড ওয়ার্কার্স ইউনিয়নে’র আন্দোলনে। সত্যজিৎ রায়ের ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবির মুক্তি নিয়ে জটিলতা দানা বাঁধলে পরিচালকের পাশে দাঁড়ান। বাড়িয়ে দেন সহমর্মিতার হাত। প্রযোজকদের দাদাগিরি আর অনভিপ্রেত হস্তক্ষেপ নিয়ে বারবার সওয়াল তুলেছেন, ‘অভিনেতৃ সঙ্ঘ’ ও ‘শিল্পী সংসদে’র নেতৃত্ব দিয়েছেন। টানা আন্দোলন চলেছে। যে কারণে বছর পাঁচেক তাঁকে ব্ল্যাক লিস্ট করে দেওয়া হয়। দীর্ঘদিন কাজ পাননি। তবুও নতজানু হননি ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। জলসা, কৌতুক নকশার রেকর্ড, যাত্রা, থিয়েটারে নেমে পড়েছেন। সংসার টানতে হিমশিম খেয়েছেন, শরীরে ধকল গিয়েছে। কিন্তু আপোসের পথে হাঁটেননি। এই জীবন্ত সংগ্রাম তাঁর সজীব সংলাপের আড়ালে ফল্গুধারার মতো অন্ত:সলিলা!

তবে তাঁকে সেভাবে কখনও প্রকাশ্যে রাজনীতির মঞ্চে দেখা যায়নি। কারণ? নিজের অভিনেতাসত্তাকে বিশেষ মতাদর্শের ছোঁয়াচ থেকে দূরে রাখতে চেয়েছিলেন? মানুষ সাম্যময় আর সেলুলয়েডের ভানুকে এক পঙক্তিতে বসাতে চাননি? তাই একটা জল-অচল ভেদ স্বেচ্ছায় গড়ে তুলেছিলেন?

সূক্ষ্ম কারণ যাই হোক না কেন, তাঁর কৌতুক কিন্তু রাজনীতির বাস্তবতাকে এড়িয়ে যেতে পারেনি। অস্ত্র ছিল কমেডি। যা ঘোরতরভাবে রাজনৈতিক। ভানুর রসিকতার স্তরে স্তরে ছড়িয়ে শ্রেণিসংগ্রামের সুর। মনে করা যাক, ‘ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিস্ট্যান্টে’র সেই সংলাপ: ‘এই শহরের বাতাসে কেমন জানি লাল লাল গন্ধ পাচ্ছি!’ সেই ‘লাল’ কেবল রহস্যের রং? নাকি সমকালীন বাম রাজনীতির প্রতীকী খোঁচা? দর্শক হাসল, সেন্সর বোর্ড খেয়াল করল না—কিন্তু সংবেদনশীল চোখে আর সচেতন কানে সেটাই গভীরতর ব্যঞ্জনা পৌঁছে দিল।

শুধু এই একটি ছবি নয়। বিখ্যাত সংলাপ ‘পেটের মধ্যে ভাত নেই, কিন্তু ভোটের কথা বলছেন!’ আজও রাজনৈতিক তির্যকতার মাপকাঠি। কিংবা ‘গারিব মানুষ কি দোষ করেচে? খালি গরিব বলে?’ নিছক কৌতুক? নাকি পঞ্চাশের দশকের খাদ্যাভাব, দুর্ভিক্ষ-উত্তর দারিদ্র্যের পটভূমিতে সৎ সামাজিক উচ্চারণ? ভানুর মুখে ‘তুই জমিদার ভূত না শ্রমিক ভূত?’ শুনে হাসির ফোয়ারা উঠেছিল হলে। কিন্তু কথার ভিতরকার আদত মর্ম রাজনীতি-সচেতন দর্শকরা বুঝেছিল নিশ্চয়ই। ‘গরিব মানুষ চাইলে বায়না হয়, বড়লোক চাইলে শখ!’ এই এক লাইনেই বুঝিয়ে দিয়েছেন শ্রেণিবৈষম্যের উচ্চাবচতা।

ভানুর কমেডি চরিত্রে বারবার ফুটে উঠেছে ‘ছোটলোকের বিদ্রোহ’। প্রভুর সামনে নতজানু না হওয়া গরিবের চোরা বিদ্রুপ। তাঁর সহকর্মী, যাঁর সিনেপর্দায় কৌতুকাভিনেতা হিসেবে স্বর্ণযুগের বাংলা চলচ্চিত্রে কমেডির একটা মান্যায়ন গড়ে দিচ্ছেন, সকলেই লোক হাসাতেন। কিন্তু ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ই হাসির ফাঁকেফোঁকরে ক্ষমতাবানকে খোঁচা দিতে জানতেন। আর সবাই মজা করতেন, ভানু চাইতেন বদল! এই ফারাকের কারণ তাঁর প্রখর রাজনৈতিক বোধ।

নকশাল আন্দোলনের সময় ছিলেন খ্যাতির শীর্ষে। চারপাশে গুলি, লাশ, পুলিশের লাঠি। অথচ পর্দায় ভানু তখনও স্বমহিমায় বিরাজমান। অভিনয়ের আঙ্গিক বদলেছে হয়তো, কিন্তু মূল অস্ত্র যেটা, কমেডি, তা হাতছাড়া করেননি। এটা অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু মানুষ সাম্যময়? তাঁর গলায় একেবারে উলটো সুর! ১৯৭১ সালে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘ছেলেরা কেন বন্দুক তুলছে, সেটা আগে বুঝতে হবে। কাজ না পেলে, পেট না ভরলে, সিনেমা দিয়ে তাদের আটকানো যায় না।’ বক্তব্যে বামপন্থার অন্তর্লীন ইস্তেহার স্পষ্ট। তিনি বিপ্লবকে সমর্থন জানাননি। কিন্তু বিপ্লবের কারণকেও অস্বীকার করেননি। একবার তো হেসেই বলেছিলেন, ‘বাবু, গুলি চালালে রক্ত ঝরবে, কিন্তু পেট ভরবে না!’

কখনও সস্তা প্রোপাগান্ডার ফাঁদে পড়েননি। ভানুর সিনেমায় বামপন্থা এসেছে সূক্ষ্ম অবয়বে, রসের মোড়কে। হাসির ভিতর দিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়া, সেটাই তাঁর অননুকরণীয় স্টাইল। এখানে ভানুর সেই বিখ্যাত স্বীকারোক্তি উল্লেখযোগ্য—‘আমি কমেডিয়ান, নেতা নই। কিন্তু যদি আমার কথা মানুষকে ভাবায়, তাতে আমার খুশি।’

কিন্তু এই মানুষ-অভিনেতার স্পষ্ট বিভাজন কি শেষতক ধরে রাখতে পেরেছিলেন? রাজনৈতিক আদর্শের প্রভাব তাঁর পেশায় কোনওভাবে ছাপ ফেলেনি? যখন ব্যবসায়ী প্রযোজকরা তাঁকে ভাঁড়ামির খোপে পুরতে চেয়েছেন, তখন ভানু দৃঢ়কণ্ঠে নাকচ করেছেন। তাঁর চিত্রনাট্যে তাই প্রায়শই ঢুকে পড়েছে মজার আড়ালে বাস্তবের খোঁচা। গরিব মানুষের স্বপ্ন, শহরের অবহেলা, ক্ষমতাশালীর অহংকার—সবই ভানুর রসবোধে গলিত হয়ে সেলুলয়েডে ভাষা পেয়েছে। তাঁর মুখের সংলাপ ‘জনতার গোপন গালি’।

তাহলে কি বলা যায়, ভানু ছিলেন পূর্ণাঙ্গ কমিউনিস্ট? দলীয় পরিচয় বা পার্টি-কার্ডের প্রমাণ মেলে না। তবে মানসিকতায়, শিল্পবোধে, সামাজিক দৃষ্টিতে তিনি ছিলেন বামপন্থী শিল্পী। কারণ তাঁর বিশ্বাস ছিল সমানাধিকারে, সাম্যের মূল্যবোধে। দারিদ্র্য, বেকারত্ব, শ্রেণিবিভাজন—সবকিছুর বিরুদ্ধে তাঁর ব্যঙ্গ ছিল অদ্ভুত শক্তিশালী। সেই ব্যঙ্গই তাঁকে সাধারণ মানুষের নায়ক করেছে।

শেষ জীবনে ভানু স্মৃতিচারণে লিখেছিলেন, ‘ছোটবেলায় ভাবতাম জমিদারই সব। বড় হয়ে বুঝলাম, জমিদারও ভুল করতে পারে। মানুষ যদি হাসতে পারে, তবে সে ভাবতেও শিখবে।’ এই দর্শনেই লুকিয়ে রয়েছে তাঁর রাজনৈতিক বোধ। হাসির অন্দরে প্রতিবাদ, রসিকতার আড়ালে অস্বস্তিকর সত্য। হয়তো এ কারণেই ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় আজও প্রাসঙ্গিক।

এই মুহূর্তে

আরও পড়ুন