শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের দাবি, সরকারের অনুরোধ, কিছুই শেষ পর্যন্ত কানে তোলেননি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শান্তা দত্ত দে। বৃহস্পতিবার তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর অনুষ্ঠান থাকায় একেবারে শেষ মুহূর্তে পরীক্ষা বাতিল করেছে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়। দিনটির কথা বিবেচনায় রেখে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় গ্র্যাজুয়েশন ও মাস্টার ডিগ্রির পরীক্ষাই রাখেনি বৃহস্পতিবার। এই ভাবে তাঁরা সরকার ও শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে সংঘাত এড়ালেও শেষ পর্যন্ত নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শান্তা দত্ত।
তাঁর এই অনড় এবং আপসহীন মনোভাব অনেককেই মীরা পাণ্ডের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। বছর বারো আগে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের তৎকালীন কমিশনার মীরা পাণ্ডে রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্তের বিপরীতে হেঁটে তিন দফায় পঞ্চায়েত নির্বাচন করিয়েছিলেন। সরকারের আপত্তি উড়িয়ে সন্ত্রাস কবলীত এলাকায় আধা সেনাও নামান।
সেই লড়াইয়ে তাঁর সহায় হয়েছিল পঞ্চায়েত ও পুরসভার নির্বাচনের ক্ষেত্রে রাজ্যপালের সাংবিধানিক দায়দায়িত্ব। অবাধ নির্বাচনের জন্য রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে সব ধরনের সহায়তার ব্যবস্থা করা রাজ্যপালের দায়িত্ব। যদিও রাজ্য সরকার বেঁকে বসায় বিবাদ গড়িয়েছিল হাইকোর্ট হয়ে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত। তবে সেই লড়াইয়ে মীরা পাণ্ডের জয়ী হওয়ার আসল কারণ ছিল কর্তব্য পালনে জেদ। কমিশনে তাঁর পূর্বসুরীরা কেউ রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরে হাঁটার কথা ভাবেননি। সরকারের সিদ্ধান্ত, নির্দেশকেই শিরোধার্য করেন।
আরও পড়ুনঃ জল পড়ে ছাতা নড়ে; ছাতা নিয়ে পড়াশোনা! হয়ে গেল স্মার্ট স্কুল
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শান্তা দত্তের ক্ষেত্রেও কাজ করেছে প্রতিষ্ঠানের গরিমা রক্ষায় ব্যক্তিগত জেদ। রাজ্যের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো তিনিও অস্থায়ী উপাচার্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। অস্থায়ী পদে থাকায় উপাচার্যদের বেশিরভাগই সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্বিধাগ্রস্ত। কঠোর ও বিতর্কিত বিষয় এড়িয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। তাঁদের মধ্যে ব্যতিক্রম হয়ে থাকলেন শান্তা।
মাস খানেক আগেই তৃণমূল ছাত্র পরিষদ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিল ২৮ অগস্টের আন্ডার গ্র্যাজুয়েট পরীক্ষা পিছিয়ে দিতে। পরে উচ্চশিক্ষা দফতরও বিশ্ববিদ্যালয়কে চিঠি পাঠিয়ে অনুরোধ করেছিল ছাত্র সংগঠনের আর্জি বিবেচনা করে পরীক্ষা পিছিয়ে দিতেস যাতে তারা সংগঠনের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর অনুষ্ঠান নির্বিঘ্নে করতে পারে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় শেষ পর্যন্ত পরীক্ষা বাতিল করেনি। অন্যদিকে, মহাজাতি সদনে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সভায় পূর্ব ঘোষণা মতো উপস্থিত ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।
শাসকের সঙ্গে বিবাদের প্রশ্নে মীরা ও শান্তার ক্ষেত্রে একটি বিষয়ে অবশ্য উল্লেখযোগ্য ফারাক আছে। মীরার সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা এবং তাঁর দল তৃণমূল সরাসরি বিবাদে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তৃণমূলের তখনকার সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় রাজ্য নির্বাচন কমিশনারকে দফতরে অবরুদ্ধ করে রাখার হুঁশিয়ারি দেন। কমিশনের অফিসের বাইরে নিত্য তৃণমূলের বিক্ষোভ লেগে ছিল। দফায় দফায় নেতা-মন্ত্রীরা গিয়ে টেবিল চাপড়ে কমিশনারকে সরে যেতে চাপ দেন।
অন্যদিকে, শান্তা দত্তের সঙ্গে তৃণমূল তথা মুখ্যমন্ত্রী-সহ মন্ত্রীরা কেউ বিবাদে জড়াননি। তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সভাপতি তৃণাঙ্কুর ভট্টাচার্য বুধবার রাতেই ঘোষণা করেন, পরীক্ষা পিছোনোর দাবি তাঁরা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। পরীক্ষার্থীদের নির্বিঘ্নে পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছনোয় সহযোগিতা করতেও সংগঠনকে অনুরোধ করেন তিনি।
ওয়াকিবহাল মহলের মতে, কলকাতা উপাচার্যের সহায় হয়েছ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট। উপাচার্য সিন্ডিকেট বৈঠকে পরীক্ষা না পিছোনোর প্রস্তাব পাশ করিয়ে নেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৭৯ সালের সংশোধিত আইন অনুযায়ী সিন্ডিকেটের হাতে বিপুল ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। উপাচার্যের নেতৃত্বে সিন্ডিকেট পরীক্ষা, ভর্তি, সিলেবাস, বিষয় ইত্যাদি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারী। সিন্ডিকেটের উপরে সর্বোচ্চ পরিচালন কমিটি হল সিনেট। বছরে দু’বার সিনেট বৈঠকে সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত অনুমোদন করা হয়ে থাকে। খুব কম ক্ষেত্রেই সিনেট হস্তক্ষেপ করে সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তে। অনেকেই মানছেন, উপাচার্য আপসের রাস্তায় হাঁটতে চাইলে তিনিই সিন্ডিকেটকে দিয়ে পরীক্ষা পিছিয়ে দিতে পারতেন।
কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকার এবং ছাত্র স্বার্থে সে পথে হাঁটেননি। সেই কারণে, চলমান পরিস্থিতিকে অনেকের কাছেই তিনি আত্মবিশ্বাসী, মেরুদণ্ড সোজা রেখে চলা প্রশাসক হিসাবে প্রশংসা পাচ্ছেন।
টিএমসিপি-র প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর দিনে পরীক্ষা বন্ধ রাখা নিয়ে বারেবারে বাম জমানার প্রসঙ্গ এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আধিকারিক-কর্মচারী সংগঠনগুলির বক্তব্য, বাম জমানায় শাসক দলের বনধ বা ধর্মঘট ডাকা হত অনেক আগে। বনধে ট্রেন, বাস চলত না। তখন পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে অলিখিতভাবে পরীক্ষা এক দু’বার পিছতে হয়েছে। তবে বেশিরভাগ সময়ই পরীক্ষা নির্দিষ্ট দিনে সম্পন্ন হয়। এবারের পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। একটি ছাত্র সংগঠনের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর অনুষ্ঠানের জন্য পরীক্ষা পিছোনোর দাবি তোলা হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দাবি, মিছিলের কারণে যানজটে কোনও পরীক্ষার্থী যাতে আটকে না যায় সে জন্য কলকাতা পুলিশকে আগাম সতর্ক করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় তার কর্তব্য করেছে। পরীক্ষাও নির্বিঘ্নেই হয়েছে।



