শ্রীলঙ্কা, তারপর বাংলাদেশ। এখন নেপাল। ভারতকে ঘিরে থাকা একের পর এক প্রতিবেশী রাষ্ট্রে উত্তাল পরিবর্তনের ডাক। আর এই বদলে ভাগ্যচক্রের চাকা কোনদিকে ঘুরতে চলেছে, এই প্রশ্নটাই এখন বিরাট হয়ে দেখা দিয়েছে নয়াদিল্লির সামনে। শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশেও যেমন এই বিদ্রোহের সামনের সারিতে ছিলেন জেন জি অর্থাৎ হাল প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা। তেমনই নেপালেও এই মুহূর্তে সরকারের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছে জেন জি যুগের নব্য প্রজন্ম। সব জায়গাতেই লড়াইয়ের সুর বাঁধা হয়েছে দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন। দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারকে হটিয়ে নতুন স্বচ্ছ প্রশাসনকে গদিতে বসানোই লক্ষ্য। কিন্তু, সত্যিই কি এর পিছনে রয়েছে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবাবেগ। নাকি এই পুতুলনাচে পিছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে ভারতশত্রু অন্য কোনও দেশ? কে হতে পারে তারা, পাকিস্তান, চিন নাকি আমেরিকা, এটাই আপাতত লাখ টাকার প্রশ্ন।
অশান্ত নেপাল ভারতের কাছে অবশ্যই অতি উদ্বেগের বিষয়। যার শিকড় অত্যন্ত গভীরে পোঁতা রয়েছে। সীমান্ত সমস্যা, চিনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব, অস্ত্র ও মাদক পাচার ও জাল নোট নিয়ে ভাবনা রয়েছে ভারতের। নেপালের সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্ক আজকের নয়, রামায়ণের যুগ থেকে। নেপালের যুবসমাজের এই ক্ষোভের কারণ শুধু সোশ্যাল মিডিয়া নিষিদ্ধ করে দেওয়ার জন্য নয়। ক্ষুদ্র পাহাড়ি রাষ্ট্রের জেন জি প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা চাইছে পালাবদলের। ‘গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ’ সরকারের কাজকর্মে তারা হতাশ। তাই ভিতরে ভিতরে ফের হিন্দুরাষ্ট্র ও রাজতন্ত্রে ফিরে যাওয়ার একটা চোরাস্রোত বয়ে চলেছে কিছুকাল ধরে। বিশেষত, একদা খতম হয়ে যাওয়া রাজবংশের উত্তরসূরি জ্ঞানেন্দ্র বিক্রম সিং দেব (যিনি নেপালের শেষ রাজা) ঘরে ফেরা ইস্তক দেশে একটি অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
আরও পড়ুনঃ ‘আগুনে ঘৃতাহুতি’ ফেসবুক বন্ধ হতেই! ছাত্র-যুবরা ঢুকে পড়লেন নেপালের পার্লামেন্টে; পথে সেনা, নিহত ছ’জন
২০০১-২০০৮ সাল পর্যন্ত তিনিই ছিলেন নেপালের রাজা। ২০০১ সালে রাজপরিবারে গণহত্যার নায়ক জ্ঞানেন্দ্র সিংহাসনে বসেন। কিন্তু মাওবাদী গৃহযুদ্ধে প্রচণ্ডর নেতৃত্বে সিংহাসনচ্যুত হয়ে বিদেশে পালিয়ে যান রাজা। তারপরেই রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে নেপাল প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়। কিন্তু জ্ঞানেন্দ্রর ফিরে আসাকেও রাজনৈতিক তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ তাঁর ফেরার দিনেই কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনে ও তাঁর যাত্রাপথে বিশাল জমায়েত হয়েছিল। যেখান থেকে স্লোগান উঠেছিল, ফিরুক রাজতন্ত্র, হোক হিন্দু রাষ্ট্র।
দেশে ফেরার পর তিনি একটি ভিডিও বার্তায় দেশবাসীকে চলমান অপশাসনের বিরুদ্ধে সরব হতে আহ্বান জানান। তারপরই সক্রিয় হয় রাজ পরিবারের ঘনিষ্ঠ দল রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র পার্টি। সেই দলই বিক্ষোভের ডাক দিয়েছিল এর আগেই। সেবারেও ব্যাপক মারামারি, কার্ফু জারি করতে হয়েছিল।
মাওবাদী নেতা ছিলেন এককালে। তবে এখন সেই দুর্গা প্রসাই রাজতন্ত্র এবং হিন্দু রাষ্ট্রের দাবি তুলে সরব হয়েছেন নেপালে। চলমান আন্দোলনের অন্যতম ‘মুখ’ এই প্রাক্তন মাওবাদী কমান্ডার। নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলির সরকার কড়া হাতে দমন করতে পারেন রাজতন্ত্রের দাবি তোলা রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে। একটি রিপোর্টে দাবি করা হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় প্রজাতান্ত্রিক পার্টির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট রবীন্দ্র মিশ্র এবং সাংসদ তথা দলের সাধারণ সম্পাদক সমশের রানার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করা হতে পারে। আপাতত তাঁরা জেল হেফাজতে আছেন। তাঁদের মধ্যে সমশের রানা ক্যানসার আক্রান্ত। তিনি ভারতে চিকিৎসা করাচ্ছিলেন। তবে রানা এবং রবীন্দ্রর পাসপোর্ট ‘বাজেয়াপ্ত’ করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে রিপোর্টে।
আরও পড়ুনঃ ভরদুপুরে আচমকা বাগুইআটিতে সরকারি AC বাসে আগুন, কালো ধোঁয়ায় ঢাকল চারপাশ
নেপালে রাজতন্ত্র ও হিন্দুত্ব ফিরিয়ে আনার দাবিতে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছে, তাতে আরপিপি ছাড়া অংশ নিচ্ছে বেশ কয়েকটি হিন্দুত্ববাদী সংগঠন। এই সব দল এবং সংগঠন মিলে গড়ে উঠেছে জয়েন্ট পিপলস মুভমেন্ট কমিটি। সেই কমিটির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতা প্রাক্তন মাও নেতা দুর্গা। পুলিশের অভিযোগ, গত ২৮ মার্চ কাঠমান্ডুতে অশান্তির সূচনা তিনিই করেছিলেন। সেদিনের সেই হিংসায় মারা গিয়েছিলেন ৩ জন। আরপিপির শীর্ষ স্থানীয় বেশ কয়েকজন নেতা সহ শতাধিক মানুষকে গ্রেফতার করা হয়।
মানুষের সেই ক্ষোভেই ঘি ঢেলেছে সরকার নিজেই। দুর্নীতি, দমনপীড়ন এবং নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অনাস্থার আগুনে জ্বলছে দেশ। তরুণ-কিশোররা রাস্তায় নেমে দাবি তুলছেন সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ না করে দুর্নীতি বন্ধ হোক। শ্রীলঙ্কা-বাংলাদেশের মতোই তাঁদের সকলের হাতেই লাল-নীল জাতীয় পতাকা। এর ছাত্র বললেন, আমাদের প্রতিবাদ কেবল মিডিয়া নিষিদ্ধ করার জন্য দুর্নীতির বিরুদ্ধে যা নেপালে এক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। আরেক ছাত্র জানান, সরকার কর্তৃত্ববাদী হয়ে গিয়েছে, আমরা এর শেষ দেখতে চাই।