হাতের ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে টালিগঞ্জের বাসিন্দা চন্দন দাস পাশে দাঁড়ানো এক সহযাত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘কখন আসবে বলুন তো মেট্রো?’’ হাত নেড়ে, ঠোঁট উল্টে সহযাত্রী বুঝিয়ে দিলেন তিনি বলতে পারবেন না। পাশের এক সহযাত্রী বললেন, ‘‘১৫ মিনিট তো হয়ে গেল আগের মেট্রোটা গিয়েছে। দেখুন এ বার চলে আসবে হয়তো!’’ সকলেই বার বার স্টেশনে লাগানো ডিসপ্লে-বোর্ডের দিকে তাকাচ্ছেন। আর অসহায় ভাবে মাথা নাড়ছেন। কারণ, ওই ডিসপ্লে-বোর্ড তো অন্ধকার! অর্থাৎ পরের ট্রেন কখন আসবে, তার কোনও উল্লেখ নেই। শুধু জ্বলজ্বল করে দেখাচ্ছে ক’টা বাজল।
গত বৃহস্পতিবার চাঁদনি চকে শেষ শহিদ ক্ষুদিরামগামী মেট্রোর আসার কথা ছিল রাত ৯টা ৫৪ মিনিটে। কিন্তু অফিসফেরত নিত্যযাত্রী মৌমিতা চক্রবর্তী স্টেশনে গিয়ে দেখেন কোথায় মেট্রো! ঘড়ির কাঁটা ঘুরেই চলেছে ১০টা, ১০টা ০৫ মিনিট…. কখন মেট্রো আসবে, ডিসপ্লে-বোর্ডে-এও কোনও উল্লেখ নেই। শুধু দেখাচ্ছে ক’টা বাজে! শেষ পর্যন্ত বৃহস্পতিবার শহিদ ক্ষুদিরামগামী শেষ মেট্রো চাঁদনিতে আসে রাত ১০টা ২০ মিনিট নাগাদ।
শুক্রবার থেকে ব্লু লাইনের (দক্ষিণেশ্বর থেকে শহিদ ক্ষুদিরাম) কোনও স্টেশনের ডিসপ্লে-বোর্ডে মেট্রো আসার কোনও সময়ের দেখা নেই! নিত্যযাত্রীদের অভিযোগ, কখন মেট্রো আসবে বোঝাই যাচ্ছে না। কেউ কেউ আবার রসিকতা করে বলছেন, ‘‘আগে তাও সময়ে মেট্রো আসছিল না। এখন তো দেখছি মেট্রো সময়টাই তুলে দিল।’’ কারও কারও কথায়, ‘‘কলকাতা মেট্রো তো টাইম মেশিনে চেপে ফিরে যাচ্ছে পুরনো দিনে। আস্তে আস্তে দেখছি প্রাগৈতিহাসিক যুগে চলে গিয়েছে মেট্রো!’’
আরও পড়ুনঃ অঙ্কটা অবশ্যই চমকে দেওয়ার মতো; ৪০ হাজার কোটির ব্যবসা, লক্ষাধিক কর্মসংস্থান!
১৯৮৪ সালে প্রথম পাতালরেল শুরু হয় কলকাতায়। কলকাতার প্রাচীনতম মেট্রোপথ ব্লু লাইন একদা সত্যিই নীল রক্তধারী ছিল। কারণ, তার কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। উত্তর কলকাতা থেকে দক্ষিণ কলকাতায় পৌঁছে যাওয়া যেত নির্ঝঞ্ঝাটে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মেট্রোও আধুনিকতার জুতোয় পা গলিয়েছে। একে একে সম্প্রসারণ হয়েছে মেট্রোপথের। এখন কলকাতা মুড়ে গিয়েছে মেট্রোর জালে। তবে ব্লু লাইন যেন ক্রমশ ধুঁকতে শুরু করেছে। পরিষেবা শিকেয় উঠেছে।
কলকাতায় তিন মেট্রোপথের সংযুক্তির খবর যাত্রীদের মধ্যে যতটা উচ্ছ্বাসের জন্ম দিয়েছিল, পরিষেবা সংক্রান্ত ভোগান্তিতে সেই উৎসাহ ইতিমধ্যেই ফিকে হতে শুরু করেছে। ইস্ট-ওয়েস্ট (গ্রিন লাইন) এবং নোয়াপাড়া-বিমানবন্দর (ইয়েলো লাইন) মেট্রোর পরিষেবা নিয়ে যাত্রীদের ততটা অভিযোগ না থাকলেও ব্লু লাইন নিয়ে বিস্তর অভিযোগ। এক যাত্রীর কথায়, ‘‘সময়ে মেট্রো না-চলা যেন রোগে দাঁড়িয়েছে।’’ কোন ওষুধে এই রোগ সারবে? জানেন না মেট্রো কর্তৃপক্ষও।
গত মাসখানেক ধরে কলকাতা মেট্রোয় একের পর এক বিভ্রাট দেখতে দেখতে একরকম অভ্যস্তই হয়ে গিয়েছেন নিত্যযাত্রীরা। ব্লু লাইনের প্রান্তিক স্টেশন কবি সুভাষে মেট্রোর পিলারে ফাটল দেখা দেওয়ায় ওই স্টেশনটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেই শুরু সমস্যার। কবি সুভাষ বন্ধ হওয়ায় এখন ব্লু লাইনের দক্ষিণগামী প্রান্তিক স্টেশন শহিদ ক্ষুদিরাম। কিন্তু শহিদ ক্ষুদিরামে প্রান্তিক স্টেশনের সুবিধা না-থাকায় সমস্যা বেড়েছে।
পরিষেবা কী ভাবে আবার মূল ট্র্যাকে ফিরিয়ে আনা যায়, তা নিয়ে বিস্তর ভাবনাচিন্তা করছেন মেট্রো কর্তৃপক্ষ। বৃহস্পতিবার মেট্রোরেলের তরফে জানানো হয়েছে, কবি সুভাষ স্টেশন বন্ধ থাকার কারণে ব্লু লাইনে দক্ষিণেশ্বর থেকে শহিদ ক্ষুদিরাম পর্যন্ত পরিষেবা চলছে। তবে সব ট্রেন দক্ষিণেশ্বর-শহিদ ক্ষুদিরামের মধ্যে চালানো সম্ভব হচ্ছে না। কিছু ট্রেন মহানায়ক উত্তমকুমার (টালিগঞ্জ) পর্যন্ত যাতায়াত করছে। ব্লু লাইনে আপ-ডাউন মিলিয়ে যে ২৭২টি পরিষেবা চলে, তার মধ্যে ৩২টি টালিগঞ্জ-দক্ষিণেশ্বরের মধ্যে চলছে। যেহেতু শহিদ ক্ষুদিরামে প্রান্তিক স্টেশনের সুবিধা নেই, তাই সব ট্রেন ওই পর্যন্ত চালানো আপাতত সম্ভব নয় বলেই জানিয়েছেন মেট্রো কর্তৃপক্ষ। নিত্যযাত্রীদের প্রশ্ন, ‘‘তাতে কোথায় সমস্যা কমল?’’
শহিদ ক্ষুদিরাম থেকে রোজ মেট্রো ধরে এসপ্ল্যানেড আসেন সৌগত রায়। আবার একই পথে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরেন। তাঁর কথায়, ‘‘কখনও সময়ে মেট্রো পাই না। রোজ কোনও না কোনও কারণে দেরি হয়ে যাচ্ছে। শহিদ ক্ষুদিরাম থেকে সময়ে ছাড়লেও যে কোনও স্টেশনে অজ্ঞাত কারণে দাঁড়িয়ে পড়ছে। কখনও পাঁচ মিনিট, কখনও ১০ মিনিট, কখনও আবার ১৫ মিনিটও দাঁড়িয়ে থাকছে মেট্রো।’’ যাত্রীদের দাবি, রোজই কোনও না কোনও রেকে প্রযুক্তিগত সমস্যা দেখা দিচ্ছে। আবার সিগন্যালের সমস্যা। মোদ্দা কথা, সময় মানছে না মেট্রো।
আরও পড়ুনঃ আবার উত্তপ্ত খেজুরি! চলল লাগাতার বোমাবাজি
অনেকেরই প্রশ্ন, অসময়ের রোগ আড়াল করতেই কি ডিসপ্লে-বোর্ডে ট্রেন আসার সময় দেখানো তুলে দিল মেট্রো? যাত্রীদের অবশ্য সেই মত। বরাহনগর থেকে চাঁদনি আসার জন্য নিয়মিত সকাল ১০টা থেকে ১০টা ১০ মিনিটে মেট্রো ধরেন শম্পা মণ্ডল। শুক্রবার তিনি যখন বরাহনগর স্টেশনে পৌঁছোন, তখন স্টেশনের ঘড়িতে দেখাচ্ছিল ১০:০৭। কার্ড পাঞ্চ করে, সিঁড়ি দিয়ে নেমে তিনি যখন প্ল্যাটফর্মে পৌঁছোলেন, দেখলেন ডাউনের ট্রেনটি বেরিয়ে গেল। তখন ১০:১০। পরের মেট্রো কখন দেখার জন্য ডিসপ্লে-বোর্ডে তাকিয়ে খানিক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যান। সময় দেখাচ্ছে না। শম্পার কথায়, ‘‘ভেবেছিলাম মেট্রোর কোনও প্রযুক্তিগত সমস্যা। তখন সেটা অত মাথা ঘামাইনি। দেখলাম ১০টা ১৩ মিনিটে পরের মেট্রো চলে এল। উঠলাম তাতে। বুঝলাম আগের ট্রেনটা লেট করেছে। সেই মেট্রো নোয়াপাড়া ছাড়া পরই গতি কমিয়ে দেয়। দমদমে ঢোকার বেশ কিছুটা পথ আগে দাঁড়িয়ে যায়। ঘড়িতে তখন ১০:২২। পাঁচ মিনিট পর ছাড়ল। তবে দু’মিনিট পর দমদমে ঢোকার আগে আবার দাঁড়িয়ে পড়ে। তার পরে মিনিট খানেক পর শেষমেশ দমদমে ঢোকায় ট্রেন। ১০টা ৩১ মিনিটে দমদম থেকে ছাড়ে মেট্রোটি। তবে বাকি পথ তেমন কোনও সমস্যা হয়নি।’’ ফেরার পথেও শম্পা দেখেন ডিসপ্লে-বোর্ডে পরবর্তী ট্রেনের কোনও সময় নেই! তাঁর কথায়, ‘‘বুঝলাম এটা মেট্রোর নতুন রোগ।’’
মেট্রোর ডিসপ্লে-বোর্ড বন্ধ করে দেওয়ার নেপথ্যে কী কারণ? আনুষ্ঠানিক ভাবে মেট্রো কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তবে মেট্রোর এক সূত্রে দাবি, বিভ্রান্তি এড়াতেই আপাতত এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কিসের বিভ্রান্তি? ওই সূত্রের দাবি, নানা কারণে পরিষেবা সময়ে চালানো সম্ভব হচ্ছে না। তাই ডিসপ্লে-বোর্ডে ট্রেন আসার সময় দেওয়া সাময়িক ভাবে বন্ধ করা হয়েছে। যাত্রীরা এতে কম বিভ্রান্ত হবেন! আদৌ কি তাই? মেট্রোর যুক্তিতে হাসছেন যাত্রীরা। তাঁদের কথায়, ‘‘এতে সমস্যা কমেনি, বরং বেড়েছে।’’