Thursday, 16 October, 2025
16 October
HomeকলকাতাKali Puja 2025: “ওপার আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকে…”; মাত্র ৩৬-এ জীবনখাতা শেষ,...

Kali Puja 2025: “ওপার আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকে…”; মাত্র ৩৬-এ জীবনখাতা শেষ, আজও মা কালী আসেন বাংলায় পান্নালালের গানে

মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে নিজের জীবনখাতা শেষ করে গেলেন শ্যামাসঙ্গীতের সেই মরমিয়া সুরসাধক।

অনেক কম খরচে ভিডিও এডিটিং, ফটো এডিটিং, ব্যানার ডিজাইনিং, ওয়েবসাইট ডিজাইনিং এবং মার্কেটিং এর সমস্ত রকম সার্ভিস পান আমাদের থেকে। আমাদের (বঙ্গবার্তার) উদ্যোগ - BB Tech Support. যোগাযোগ - +91 9836137343.

দেবজিৎ মুখার্জি, কলকাতাঃ

১৯৬৬ সালের মার্চের শেষ। বসন্ত তখনও হাতছানি দিচ্ছে শহরের হিমেল হাওয়ায়। হলুদ তেল মাখা রোদ আর কমলালেবুর কোয়ার কামড়ে যখন বুঁদ হচ্ছে তামাম শহরবাসী ঠিক তখনই এক ঝলমলে সকালে দক্ষিণ কলকাতার এক ভাড়াবাড়িতে মিলল সঙ্গীতশিল্পী পান্নালাল ভট্টাচার্যের ঝুলন্ত দেহ। মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে নিজের জীবনখাতা শেষ করে গেলেন শ্যামাসঙ্গীতের সেই মরমিয়া সুরসাধক। যেন তাঁরই গাওয়া — “ওপার আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকে…” গানটি হয়ে উঠল নিজের জীবনের ভবিষ্যদ্বাণী।

বালির বারেন্দ্রপাড়ার সেই দুরন্ত ছেলেটি, যাকে সারা বাংলার শ্রোতা চিনত কেবল কণ্ঠের জাদুতে। গানের জগতে তাঁর আগমন যেন উল্কার মতো—দ্রুত, দীপ্ত, অথচ ক্ষণস্থায়ী। দাদা ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের হাত ধরেই সুরের পথে যাত্রা শুরু তাঁর। কিন্তু তিনি শুধু ধনঞ্জয়ের ছায়া নন, ছিলেন এক স্বাধীন কণ্ঠসাধক—যিনি শাক্ত পদাবলির সহজিয়া ধারাকে এনে দিয়েছিলেন এক নতুন আত্মা।

আরও পড়ুনঃ কৃষ্ণা দশমীতে শুভ যোগের সঙ্গে শুক্লা যোগ; জীবনে বড় চমক এই চার রাশির

কিশোর বয়স থেকেই পান্নালালের মধ্যে ছিল এক অদ্ভুত নিঃসঙ্গতা। গঙ্গার ঘাটে, শ্মশানের ধারে বসে মা কালীকে খুঁজতেন তিনি। সেই খোঁজই হয়তো তাঁকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল শ্যামাসঙ্গীতের মর্মে। জীবনজুড়ে যেন চলছিল দেবী আর মানুষের, বিশ্বাস আর বিষাদের এক অনন্ত সংলাপ।

জীবনের শুরুটা সহজ ছিল না। পান্নালাল গান শিখতে গিয়েছিলেন জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, পরে যামিনীরঞ্জন গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে। কিন্তু কোনও বাঁধাধরা নিয়ম, কোনও তালিম তাঁর মন মানেনি। ছিলেন সম্পূর্ণ স্বশিক্ষিত। তাঁর কণ্ঠে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মাধুর্য মিশে গিয়েছিল মরমিয়া ভক্তির আবেগে। সেই মিশেলেই যেন জন্ম নেয় এক অনন্য ‘পান্নালালীয়’ ধারা।

ছ’য়ের দশকে বাংলা গানের পরিমণ্ডলে বদল আসছিল। গণনাট্য, আধুনিক, সিনেমার গান—সব মিলিয়ে সুরের রঙ পাল্টাচ্ছিল। কিন্তু ভক্তিরসের সহজ স্রোত তখনও শুকোয়নি। ধনঞ্জয়ের পরামর্শেই পান্নালাল এগিয়ে এলেন শ্যামাসঙ্গীত গাইতে। “অপার সংসার নাহি পারাপার”, “চাই না মাগো রাজা হতে”, “আমার সাধ না মিটিল, আশা না পুরিল”— প্রতিটি গানেই যেন ছিল এক অন্তর্লীন আর্তি। মা কালীর প্রতি তাঁর নিবেদনই হয়ে উঠেছিল নিজের অস্তিত্বের ভাষা।

তবে এই শিল্পী ছিলেন দ্বিধার ভিতরে বন্দি। বাইরের পৃথিবীতে তিনি ছিলেন জনপ্রিয়, কিন্তু ভিতরে গভীর অস্থিরতা। সাধকের পোশাক তাঁর বেপরোয়া প্রাণ মানেনি।  তিনি ছিলেন এক সাধারণ মানুষ—যিনি ভক্তির আড়ালে খুঁজছিলেন জীবনের অর্থ। মৃত্যুর আগের দিন নিজ হাতে রান্না করেছিলেন স্ত্রীর জন্য, বন্ধুর জন্য।

আরও পড়ুনঃ বাংলা এসেছেন কর্তারা, সব কাগজ রয়েছে তো? আধার কার্ড কি মান্যতা পাবে?

মায়ের আকুতি ক্রমশ বাড়ছিল তাঁর। একবার অনুষ্ঠান শেষে শিল্পী বন্ধুদের সঙ্গে ট্রেনে করে ফিরছেন। হঠাৎই বালি নামার একটু আগে পান্নালাল বলে উঠলেন, মাকে তুঁতে বেনারসী পরানো হয়েছে! কেউ বিশ্বাস করছেন না তাঁর কথা। শেষে নিজেই বললেন, নেমে চলো, দেখে আসি। হইহই করে ট্রেন থেকে নেমে পড়লেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, নির্মলা মিশ্র, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুপ্রীতি ঘোষের মতো শিল্পীরা।

মৃত্যুর পর আরও জনপ্রিয় হলেন পান্নালাল। কালীপুজোর সময় তাঁর গলা বাজলেই মনে হয়, ভক্তিরস আর বিষাদের মিশ্রণে তৈরি কোনও স্বর্গীয় সুর ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে। তাঁর গাওয়া আধুনিক গানও আজ অবধি চমকে দেয় শ্রোতাকে—যেমন “ও আমার কাজলপাখি” বা “তীরে তীরে গুঞ্জন”। তবু শেষ পর্যন্ত শ্যামাসঙ্গীতই তাঁর পরিচয়, তাঁর উত্তরাধিকার।

আজও যখন মঞ্চে বা রেডিওয় শোনা যায়—“ওঠ না ফুটে মন…”, যেন সময় থমকে দাঁড়ায়। যে মানুষ নিজের মনকে ফুটিয়ে তুলতে পারেননি, তাঁর গলায় অন্যের মন প্রস্ফুটিত হয় আজও। পান্নালাল ভট্টাচার্য—ভক্তিরসের সুরে যিনি নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু জীবনকে বোঝার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত।

অন্ধকারের ভেতর দিয়েই যিনি আলো খুঁজেছেন, তাঁরই নাম পান্নালাল। মৃত্যু তাঁকে থামাতে পারেনি। প্রতি কালীপুজোয়, প্রতিটি শ্যামাসঙ্গীতের সুরে, বাঙালির অন্তরের প্রার্থনায় তিনি আজও বেঁচে আছেন—“মরিবার হয়েছিল তাঁর সাধ”, কিন্তু গান? তা রয়ে গেল অমরত্বের অন্য নাম হয়ে।

এই মুহূর্তে

আরও পড়ুন