‘আমিষ’ বনাম ‘নিরামিষ’? তৃণমূলের নেতানেত্রীদের ত্রিপুরা সফর ঘিরে বুধবার আগরতলায় দিনভর যা ঘটল, তাকে ত্রিপুরা বিজেপির অন্দরে ‘আমিষ-নিরামিষ’ সংঘাত বলেই ব্যাখ্যা করা হচ্ছে।
অতীতের মতোই দলের একাংশ প্রস্তুতি নিয়েছিল তৃণমূলকে ‘আমিষ’ আপ্যায়নের। কিন্তু প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে অন্য অংশ রান্না করল ‘নিরামিষ’ পদ। রান্নার আগে খানিক ঝক্কি হল বটে। তবে সায়নী ঘোষ, সুস্মিতা দেব, কুণাল ঘোষ, বীরবাহা হাঁসদারা নিরাপদেই আগরতলায় ভাঙচুর-হওয়া দলীয় দফতরে যেতে পারলেন। কর্মীদের সঙ্গে কথা বললেন। সাংবাদিক বৈঠক করলেন। ত্রিপুরা পুলিশের ডিজি-র সঙ্গে সাক্ষাতের সময় চাইলেন। সেই সময় ডিজি দিয়েও দিলেন। ফায়ার ব্রিগেড চৌমহনির কাছে রাজ্য পুলিশের সদর কার্যালয়ে গিয়ে তাঁরা ডিজির সঙ্গে দেখা করে সন্ধ্যায় ভালয়-ভালয় হোটেলেও ঢুকে পড়লেন।
আরও পড়ুনঃ ভারতই ফার্স্ট বয়! নোকিয়া, এরিকসন, স্যামসং ও হুয়াওয়েকে টেক্কা ভারতের!
কারা ‘আমিষ’ চাইল? কারাই বা ‘নিরামিষ’ করে দিল? এই নিয়ে রাজধানী আগরতলায় আলোচনা চলেছে সারাদিন। ত্রিপুরা বিজেপিতে একাধিক গোষ্ঠী রয়েছে। সংগঠনের একাংশে যেমন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেবের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, তেমনই নিয়ন্ত্রণ রয়েছে রাজ্য সভাপতি রাজীব ভট্টাচার্যেরও। একটা সময়ে বিপ্লবের সঙ্গে রাজীবের সখ্য ছিল। কিন্তু ইদানীং তেমনটা নেই বলেই দলশ্রুতি। পক্ষান্তরে, পুলিশ-প্রশাসন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সাহার নিয়ন্ত্রণে। সংগঠনের একটি অংশ চেয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে খগেন মুর্মূ-শঙ্কর ঘোষের উপর হামলার ‘পাল্টা’ দেওয়া হোক তৃণমূলকে। কিন্তু পুলিশ-প্রশাসন চায়নি। অর্থাৎ, মুখ্যমন্ত্রী মানিক চাননি। বস্তুত, তৃণমূলের প্রতিনিধিদের যে ভাবে ‘কনভয়’ করে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে গিয়েছে ত্রিপুরা পুলিশ, তাতে প্রতিনিধিদলই উল্টে হতবাক! একান্ত আলোচনায় একজন তো বলেই দিলেন, ‘‘কনভয়ে গাড়ির সংখ্যা দেখে বুঝতে পারছিলাম না, তৃণমূল যাচ্ছে? না ডোনাল্ড ট্রাম্পের কনভয় যাচ্ছে!’’
২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পরে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার পর থেকে অভিষেক গোয়া, মেঘালয়, অসমের মতো ত্রিপুরাতেও তৃণমূলের পদচিহ্ন রাখতে অগ্রসর হয়েছিলেন। কিন্তু ত্রিপুরাতেই বারংবার আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছিল তৃণমূলকে। ২০২১ সালেই অভিষেক গিয়েছিলেন উদয়পুরের ত্রিপুরেশ্বরী মন্দিরে পুজো দিতে। তখন তাঁর গাড়িতে হামলা হয়েছিল। ভেঙে দেওয়া হয়েছিল গাড়ির সামনের কাচ। সায়নীকে (তখনও সাংসদ নন) হোটেল থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে গিয়েছিল ত্রিপুরা পুলিশ। তার পরে এক বার খোয়াই থানা ঘিরে রেখে তৃণমূল নেতাদের উপর হামলা চালানোর অভিযোগ উঠেছিল বিজেপির বিরুদ্ধে।
বুধবার তেমন কোনও ঝামেলায় পড়তে হয়নি তৃণমূলকে। যদিও অতীতের ‘তিক্ত’ অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েই বুধবার সকালে কলকাতা থেকে আগরতলার উদ্দেশে রওনা দিয়েছিল তৃণমূলের প্রতিনিধিদল। তবে আগরতলা বিমানবন্দরে নামতেই বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হয় সায়নী, কুণালদের। তাঁরা যে চারটি গাড়ি ভাড়া করেছিলেন, তার মধ্যে একটি গাড়ি ছাড়া বাকি গাড়িগুলিকে বিমানবন্দর থেকে ফিরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে বিজেপির বিরুদ্ধে। অগত্যা তৃণমূলের নেতারা যান বিমানবন্দরের প্রিপেড ট্যাক্সি ধরতে। কিন্তু কোনও এক অজ্ঞাত কারণে সব ট্যাক্সিচালকই জানিয়ে দেন, যেতে পারবেন না! তৃণমূল অভিযোগ করে, এর পরে তাঁদের দলের স্থানীয় লোকজন মোটরসাইকেল নিয়ে বিমানবন্দর থেকে নেতাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য আসতে চাইলে তাঁদেরও বাধা দেওয়া হয়।
অতঃপর বিমানবন্দরেই ধর্নায় বসে পড়ে তৃণমূলের প্রতিনিধিদল। প্রায় পৌনে তিন ঘণ্টা কেটে যায় সে ভাবেই। তখনই মমতা ফোন করে এক সাংসদকে নির্দেশ দেন, দরকারে পায়ে হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছোতে হবে। নেত্রীর নির্দেশের পরেই হাঁটতে শুরু করেন তৃণমূলের প্রতিনিধিদলের সদস্যেরা। তার পর পুলিশই গাড়ির ব্যবস্থা করে তাঁদের নিরাপত্তাবেষ্টনীতে মুড়ে ফেলে।
আরও পরুনঃ “কলম কেড়ে নিতে বেশী সময় লাগবে না”; পঞ্চায়েত-জেলা পরিষদের সদস্যদের বেনজির ‘হুমকি’
বিমানবন্দর চত্বরে যে টুকু হয়েছে, সে টুকুই। তার পরে আর কোনও বিড়ম্বনায় পড়তে হয়নি তৃণমূল নেতানেত্রীদের। কিন্তু বিমানবন্দর থেকে বনমালিপুরের ভাঙচুর হওয়া কার্যালয়, ডিজি-র দফতর, সেখান থেকে হোটেল— এই গোটা পথ কি একেবারেই ‘শুকনো’ ছিল? স্থানীয় সূত্রে জানা যাচ্ছে, তা নয়। বিমানবন্দরের অদূরে ‘ভারতরত্ন’ ক্লাবের মোড়ে বিজেপির জমায়েত ছিল। সেখানেও তৃণমূলের সফর ‘আমিষ’ করার প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু পুলিশ ‘সক্রিয়’ থাকায় তা হয়নি। আগরতলার পুরনো মোটর স্ট্যান্ড এলাকার বিজেপির যুবমোর্চার এক নেতার কথায়, ‘‘আমরা তো পেঁয়াজ-রসুন বাটতে চেয়েছিলাম। পুলিশ ঘি-গরম মশলা দিয়ে দিল!’’
উত্তরবঙ্গে খগেন-শঙ্করের উপর হামলার বিরুদ্ধে মঙ্গলবার বনমালীপুরে প্রতিবাদ মিছিল করে বিজেপি। সেখান থেকেই বেশ কিছু লোক তৃণমূলের কার্যালয়ে হামলা চালায়। ঘটনাচক্রে, মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন বনমালীপুরেরই বিধায়ক ছিলেন বিপ্লব। এ-ও ঘটনাচক্রই যে, এর আগে যখন অভিষেকের উপর হামলা, সায়নী গ্রেফতার এবং খোয়াই থানায় তৃণমূল নেতাদের ঘেরাও হয়ে থাকার সময়েও মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বিপ্লব। কিন্তু জমানা বদলেছে। এখন বিপ্লব আর মুখ্যমন্ত্রী নন। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মানিক সাহা তৃণমূল পার্টি অফিসে ভাঙচুর এবং তৃণমূল প্রতিনিধিদলের সফর প্রসঙ্গে বলে দিয়েছেন, ‘‘ত্রিপুরায় তৃণমূলের লোক নেই। কেবল সাইনবোর্ড আছে। কিছু ছেলে আক্রোশে কিছু ঘটিয়েছে। সেই সুযোগ নিয়ে কলকাতা থেকে কয়েক জন এসেছেন। কিন্তু তাঁদের কোনও অসুবিধা হবে না।’’
মঙ্গলবার রাতেই তৃণমূল ঘোষণা করে দিয়েছিল বুধবার তারা ত্রিপুরায় দল পাঠাবে। উল্লেখ্য, এর আগে তৃণমূল নেতারা গিয়ে বেশির ভাগ সময়েই উঠতেন আগরতলা সার্কিট হাউসের উল্টোদিকের একটি হোটেলে। যার পাশেই রয়েছে অসম রাইফেল্সের দফতর। সেই হোটেল থেকেই বছর চারেক আগে সায়নীকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। এ বার হোটেল বদলে ফেলেছে তৃণমূল। সেই হোটেল ত্রিপুরা সরকারের সচিবালয়, বিধানসভা, রাজ্যপাল ও ত্রিপুরা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতির বাসভবনের অদূরেই। যে সংস্থার হোটেল রয়েছে পশ্চিমবঙ্গেও।
অতীতে বিভিন্ন রাজ্যে প্রতিনিধি দল পাঠিয়ে বিভিন্ন অভিজ্ঞতা হয়েছে তৃণমূলের। ২০১৮ সালে অসমের তিনিসুকিয়ায় পাঁচ বাঙালিকে গুলি করে হত্যার প্রতিবাদে মহুয়া মৈত্রদের পাঠিয়েছিলেন মমতা। সেই পর্বে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে বেশ বদলে তিনিসুকিয়ায় গিয়েছিলেন মহুয়া। পুলিশকে ধোঁকা দিতে উত্তর প্রদেশের লখিমপুর খেড়িতে পঞ্জাবি মহিলার ছদ্মবেশে পৌঁছেছিলেন রাজ্যসভার সাংসদ দোলা সেন। তবে এ বারের ত্রিপুরা সফরে কুণাল, সায়নী, বিরবাহাদের তেমন কিছু করতে হয়নি। ‘আমিষের’ আবহ থাকলেও ‘নিরামিষই’ হয়েছে প্রথম দিনের কর্মসূচি। পরিস্থিতি দেখে বৃহস্পতিবার ত্রিপুরার রাজ্যপালের সঙ্গে দেখাও করতে চেয়ে ফেলেছে তৃণমূল! ‘ট্রাম্প কনভয়’ যখন আছেই।