কুশল দাশগুপ্ত, শিলিগুড়িঃ
হুগলি জেলা জুড়ে ছড়িয়ে আছে বহু মণিমুক্ত। বাংলার ইতিহাস ও পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনের নিরিখে অন্যতম এক সম্পদশালী জেলা এই হুগলি। আজ হুগলি জেলার মাতা রাজবল্লভী দেবীর কথা। লোকমুখে যিনি দেবী শ্বেতকালী নামেও পরিচিতা। যাঁর নামেই জনপদের নাম রাজবল্লভহাট অপভ্রংশে রাজবলহাট।
দেবী রাজবল্লভী কে নিয়ে ছড়িয়ে আছে নানা মিথ। দেবী কাঠের পালংকে শয়ন করেন। তাঁর আবারও তামাকু সেবনের অভ্যাস আছে। তাই মন্দিরে রাখা থাকে গড়গড়াও।
কবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তী তাঁর চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে দেবী রাজবল্লভী মায়ের পরিচয় লিখে রেখে গিয়েছেন। তিনি বলছেন
“রাজ বোল বন্দি রাজবল্লভীর চরণ।
ইতিপুরে রঙ্গিনী বন্দো হয়ে একমন।”
লেখার শুরুতেই বলেছি হুগলি একটি অত্যন্ত সমৃদ্ধ জেলা। তার ঐতিহাসিক গুরুত্বও সেই রূপ। সাল ১১৯২, দিল্লির মসনদে তখন মহম্মদ ঘুরি। ভুরসুট পরগণায় তখন রাজত্ব করছেন দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী শনিভাঙর। প্রায় ৪০ বছর রাজত্ব করার পর নিজের জামাতা সদানন্দ রায়কে ভুরসুটের রাজা পদে স্থলাভিষিক্ত করেন শনিভাঙর। ( যা আজকের ডিহিভুরসুট, ডিহিভিরুসুট বাসরুট আজও আছে। ডিহিভুরসুটের রাণী সম্রাট আকবরের সেনাপতি মানসিংহ কে পরাজিত করে রায়বাঘিনী খেতাব পান)।
কথিত আছে সনাতন গভীর জঙ্গলে শিকার করতে গিয়ে মাতা রাজবল্লভীর দর্শন পান। মহামায়া দ্বিভূজা, অপূর্ব সুন্দরী ষোড়শী কিশোরী রূপে রাজাকে দর্শন দিয়ে আদেশ করেন ওই গহীন জঙ্গলেই তাঁর মন্দির স্থাপন করতে। রাজা সনাতন মাথা পেতে নেন দেবীর আদেশ।
স্থাপিত হয় দেবী রাজবল্লভীর মন্দির। মায়ের দৈর্ঘ্য ৬ ফুট, সাদা রঙের গাত্রবর্ণ গঙ্গামাটি দিয়ে তৈরি মায়ের অবয়ব। দেবী শ্বেতকালী নামেও পরিচিতা।
মা এখানে দ্বিভূজা। ডানহাতে তাঁর তরবারি , বামহাতে রক্ত পাত্র। গলায় মুন্ড মালা,কোমরে ছোট ছোট হাতের কটি বন্ধ। মায়ের গাত্র বর্ণ উজ্জ্বল সাদা। ডানপা ভৈরব শিবের বুকে, বামপা বিরূপাক্ষ শিবের মাথায়।
প্রশস্ত নাটমন্দির চত্বরে আছে মোট তিনটি শিবমন্দির। নাম সোমেশ্বর, ত্র্যমবকেশ্বর, বাণেশ্বর। এছাড়াও আছেন বুড়ো শিব। ধুমধাম করে গাজন হয়। রয়েছে মা রাজবল্লভীর দিঘি।
মা কে দুর্গা রুপে আবাহন করে পুজো হয় পাঁচদিন। সামনেই দুর্গাপুজো ঘুরে আসতে পারেন রাজবলহাট ও আঁটপুর।।
আরও পড়ুনঃ গুরুত্বপূর্ণ এই পুজো! সন্ধিপুজোয় দেবী দুর্গার বদলে এই সময় পূজিতা হন তাঁরই উগ্র ও ভয়াল এক রূপ
ভোগখাওয়ার বন্দোবস্ত: প্রতিদিন সকাল ১১ টায় কুপন দেওয়া হয়, মূল্য ৪০ টাকা। মায়ের ভোগে তেলমশলা পড়েনা, সমস্ত সবজি ও মাছ দিয়ে একটা ঘন্ট মা’কে প্রতিদিন নিবেদন করা হয় এটি মায়ের ভোগের অন্যতম বিশেষত্ব।
পুজোর উপাচার: মন্দিরের সামনে রয়েছে প্রচুর ডালার দোকান। ৫০ টাকা থেকে শুরু। চাইলে মায়ের ছবিও সংগ্রহ করতে পারেন। ১৫ টাকা থেকে দাম শুরু।
সন্ধ্যারতি: রোজ রাত ৯ টায় মায়ের সন্ধ্যারতি ও শেতল দিয়ে দর্শন বন্ধ হয়। মা বিশ্রাম নেন।
যা চেখে দেখতে ভুলবেন না: রাজবলহাটের মাখা সন্দেশের স্বাদ নিতে অবশ্যই ভুলবেননা
কেনাকাটা: হুগলির এই জনপদ তাঁতশিল্পের জন্য ভারত বিখ্যাত। অবশ্যই শাড়ি বা অন্যকোন পোশাক পছন্দসই নিতে পারেন।
কীভাবে যাবেন : হাওড়া স্টেশন থেকে সরাসরি রাজবল্লভী মায়ের মন্দির পর্যন্ত বাস যাচ্ছে। প্রথম বাস সকাল সাতটা, শেষ বাস দুপুর সাড়ে তিনটে। ভাড়া ৫০ টাকা। সময় লাগবে তিনঘণ্টা।
তারকেশ্বরগামী লোকালে হরিপাল স্টেশনে নেমে বাস অথবা ট্রেকার পাবেন। ভাড়া ৩০ টাকা। শেষ বাস মন্দিরের সামনে থেকে ছাড়ে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়।
আসন্ন শারদোৎসবে যাঁরা গ্রামবাংলার পুজো দেখবেন বলে মনস্থ করেছেন তাঁদের গন্তব্য হতেই পারে