কলকাতার ঐতিহাসিক আলিপুর চিড়িয়াখানায় প্রাণী নিখোঁজ! প্রায় দেড়শো বছরের পুরনো এই চিড়িয়াখানার প্রশাসনিক গাফিলতির অভিযোগ তুলে হাইকোর্টে মামলা করেছে ‘স্বজন’ নামের একটি শহরভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। সংস্থার দাবি— ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষে চিড়িয়াখানায় ৬৭২টি প্রাণী ছিল, কিন্তু ঠিক পরের দিন অর্থাৎ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শুরুতে এই সংখ্যা নেমে আসে ৩৫১-এ। মাত্র একরাতেই গায়েব ৩২১টি প্রাণী!
জানা গেছে, এই বিপুল গরমিল ধরা পড়েছে কেন্দ্রীয় চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ (CZA)-এর বার্ষিক ‘Annual Inventory of Animals in Zoos’ রিপোর্ট থেকে। ১ জুলাই কলকাতা হাইকোর্টে দায়ের করা পিটিশনে সংস্থাটি দাবি করেছে, এটি একেবারে নজিরবিহীন তথ্য বিকৃতি এবং দীর্ঘ ৩০ বছর ধরেই এমন অনিয়ম চলছে।
আরও পড়ুনঃ দুধে ঘাটতির আশঙ্কা! বুধবার থেকেই দুধের সঙ্কট?
সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যম ‘দ্য প্রিন্ট’-এর একটি বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছর থেকে শুরু করে ২০২৫ পর্যন্ত প্রায় প্রতি বছরই চিড়িয়াখানার প্রাণীসংখ্যার বার্ষিক রিপোর্টে গরমিল দেখা গেছে। কখনও ৫টা, কখনও ১০টা, আবার কখনও ২০০-৩০০টি প্রাণী কমে বা বেড়ে গেছে ‘অজানা’ কারণে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৯৬ সালের ৩১ মার্চ আলিপুর চিড়িয়াখানায় ১,৮০৫টি প্রাণী ছিল, কিন্তু ১ এপ্রিলেই সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১,৮৭২। প্রতি বছরই এমন হিসাবের অমিল লক্ষ্য করা গিয়েছে।
বিশ্ব অ্যানিমাল প্রোটেকশন ইন্ডিয়ার ওয়াইল্ডলাইফ রিসার্চ ম্যানেজার শুভব্রত ঘোষ বলেছেন, “এই অস্বাভাবিক সংখ্যায় প্রাণী গায়েব হওয়া শুধু প্রশাসনিক গাফিলতির নয়, বরং অবৈধ বন্যপ্রাণী পাচারের ইঙ্গিতও দিতে পারে।”
চিড়িয়াখানার অধিকর্তা অরুণ মুখোপাধ্যায় এ বিষয়ে জানিয়েছেন, “এই গরমিল শুধুমাত্র গণনার ভুল। আমাদের অভ্যন্তরীণ হিসাব আর CZA-এর রিপোর্টে গণ্ডগোল হয়েছে, আমরা ঠিক করার চেষ্টা করছি।”
তবে শুভব্রত ঘোষ বলছেন, “এক-দুই বছরের ভুল গণনা মানা যায়, কিন্তু ৩০ বছর ধরে এমন গরমিল একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়।”
২০২১-২২ এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য তো আলিপুর চিড়িয়াখানার ইনভেন্টরি রিপোর্টই পাওয়া যায়নি, যদিও তা বার্ষিকভাবে জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক।
২০২৫ সালের ৩১ মার্চ প্রকাশিত সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী, চিড়িয়াখানায় বর্তমানে ১,১৮৪টি প্রাণী রয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, ২০২৪ সালের তালিকায় যেসব বেঙ্গল টাইগার, এশিয়াটিক লায়ন, গন্ডার, হাতি, চিতা, শিয়াল ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত ছিল, সেগুলোর কোনও উল্লেখ ২০২৫ সালের তালিকায় নেই। অথচ দর্শনার্থীদের তোলা সাম্প্রতিক ভিডিও ও ছবি প্রমাণ করছে, এই প্রাণীগুলো এখনও চিড়িয়াখানাতেই রয়েছে!
আরও পড়ুনঃ পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে গুজরাতে, রাজস্থানে চলে গেল ৬৬৮৮টি সংস্থা
পিটিশনে আরও দাবি করা হয়েছে, প্রাণীগুলোর সংখ্যা কৃত্রিমভাবে কমিয়ে ফেলার পিছনে রয়েছে আরও গভীর ষড়যন্ত্র। রাজ্য সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, আলিপুর চিড়িয়াখানার ৩৪এ, বেলভেডিয়ার রোডের ৩ একরের একটি গুরুত্বপূর্ণ জমি নাকি কমার্শিয়াল ব্যবহারের জন্য বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে।
এই জমিতেই রয়েছে চিড়িয়াখানার ভেটেরিনারি হাসপাতাল, রেসকিউ সেন্টার, ময়নাতদন্ত ইউনিট এবং পাবলিক অ্যাকোয়ারিয়াম। অথচ পশ্চিমবঙ্গ হাউজিং ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন এই জমি বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য ই-টেন্ডার দিয়েছে। চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ বলেছে, বিষয়টি এখন আদালতের বিচারাধীন, তাই তারা মন্তব্য করতে নারাজ।
এনজিও-র অভিযোগ, চিড়িয়াখানার প্রাণী কমানো হচ্ছে, এখন জমিও কমানো হচ্ছে। এভাবে ধাপে ধাপে চিড়িয়াখানার অস্তিত্ব ধ্বংস করে জায়গাটি বেসরকারি রিয়েল এস্টেটের হাতে তুলে দেওয়ার ছক চলছে।
CZA-র গাইডলাইন অনুযায়ী, ৭০০টির বেশি প্রাণী ও দেশি-বিদেশি প্রজাতির বৈচিত্র্য থাকলে চিড়িয়াখানাকে ‘লার্জ জু’ হিসেবে ধরা হয়। আগে আলিপুর চিড়িয়াখানার প্রাণীসংখ্যা এই মানদণ্ডে পড়লেও এখন তা কমে যাওয়ায় এটি ‘মিডিয়াম সাইজ জু’ হিসেবে নথিভুক্ত হয়েছে। পিটিশনে একে সরকার-চালিত ‘ইচ্ছাকৃত সংকোচন’ বলা হয়েছে।
দেশে বর্তমানে ১৫৭টি স্বীকৃত চিড়িয়াখানা রয়েছে। আলিপুর চিড়িয়াখানার এই ঘটনায় গোটা ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনার দাবি জানিয়েছেন শুভব্রত ঘোষ। তিনি বলেন, “এই ঘটনায় পরিষ্কার—চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ এবং কেন্দ্রীয় চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ (CZA) কেউই বছরের পর বছর এই গরমিল ধরতে পারেনি। এটা বড় বিপদ। অবিলম্বে একটি স্বচ্ছ ব্যবস্থা চালু করে সারা দেশের চিড়িয়াখানাগুলির ইনভেন্টরি স্বচ্ছ করতে হবে।”
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য বন্যপ্রাণী সংরক্ষকের কাছ থেকে রিপোর্টও তলব করেছে কেন্দ্রীয় চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ। ২৪ জুলাই এই মামলার শুনানি হওয়ার কথা কলকাতা হাইকোর্টে।
মামলাকারী এনজিও চাইছে, চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষকে গত ১০ বছরের বার্ষিক ইনভেন্টরি পেশ করতে নির্দেশ দিক আদালত এবং সমস্ত গরমিলের ব্যাখ্যা দিতে বলা হোক।