কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে পরস্পরবিরোধী দুই বার্তা এল ওয়াশিংটন থেকে। ভারত-আমেরিকা দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিয়ে। প্রথমটি, মার্কিন বিদেশসচিব মার্কো রুবিয়োর তরফে। দ্বিতীয়টি, সে দেশের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের। রুবিয়োর দাবি ছিল, ভারত-আমেরিকার সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী। এই সম্পর্ক ভবিষ্যতে আরও উন্নত হবে। কিন্তু ট্রাম্প সরাসরি শুল্কবিবাদের আবহে ভারতের বিরুদ্ধে সুর চড়িয়ে অভিযোগ করলেন, দশকের পর দশক ধরে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে একতরফা ফায়দা লুটেছে ভারত।
ঘটনাচক্রে, তিয়ানজ়িনে শাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) শীর্ষসম্মেলনের ফাঁকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে পার্শ্ববৈঠক করার পরেই নয়াদিল্লির বিরুদ্ধে নতুন করে অভিযোগ করেছেন ট্রাম্প। সেই সঙ্গে সোমবার সন্ধ্যায় ভারতীয় পণ্যের উপর জরিমানা-সহ ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের পক্ষে আবার সওয়াল করেছেন। গত কয়েক দশক ধরে চলা নয়াদিল্লি-ওয়াশিংটনের বাণিজ্যিক সম্পর্ককে ‘একতরফা বিপর্যয়’ বলে চিহ্নিত করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট! স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, ভারতীয় পণ্যের উপর থেকে জরিমানা-সহ ৫০ শতাংশ শুল্ক প্রত্যাহারের কোনও পরিকল্পনা নেই আমেরিকার।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট তাঁর সমাজমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে সোমবার লিখেছেন, ‘‘খুব কম মানুষই বোঝেন যে আমরা ভারতের সঙ্গে খুব কম ব্যবসা করি। কিন্তু তারা আমাদের সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে ব্যবসা করে। সোজা কথায় বলতে গেলে, ভারত আমাদের কাছে প্রচুর পরিমাণে পণ্য বিক্রি করে। আমরা তাদের সবচেয়ে বড় গ্রাহক (ক্লায়েন্ট)। কিন্তু আমরা তাদের খুব কম পরিমাণ পণ্য বিক্রি করি।’’ এমন পরিস্থিতি চলতে পারে না দাবি করে ট্রাম্প লিখেছেন, ‘‘ভারত এখন আমাদের উপর এত বেশি শুল্ক আরোপ করেছে, যা অন্য যে কোনও দেশের তুলনায় সর্বোচ্চ। আমরা আমাদের পণ্য ভারতে বিক্রি করতে অক্ষম। এটি সম্পূর্ণ একতরফা বিপর্যয়!’’
ভারতীয় পণ্যে শাস্তিমূলক শুল্ক প্রত্যাহারের পরিকল্পনা যে আমেরিকার নেই, সে কথাও সোমবার স্পষ্ট করে দিয়েছেন ট্রাম্প। সমাজমাধ্যমে তিনি লিখেছেন, ‘‘ভারত তার বেশির ভাগ তেল এবং সামরিক পণ্য রাশিয়া থেকে কেনে। আমেরিকা থেকে খুব কম। তারা এখন তাদের শুল্ক কমানোর প্রস্তাব দিয়েছে, কিন্তু দেরি হয়ে গিয়েছে। তাদের বহু বছর আগেই তা করা উচিত ছিল।’’ ট্রাম্পের দাবি, ভারত ২০২৪ সালে আমেরিকা থেকে ৪১৫০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছিল। অন্য দিকে, ৮০০০ কোটি ডলারেরও বেশি পণ্য রফতানি করেছিল আমেরিকায়। এই বাণিজ্য ঘাটতিকে ‘মানুষের চিন্তা করার জন্য কিছু সহজ তথ্য’ বলে চিহ্নিত করেছেন তিনি। ঘটনাচক্রে, সোমবার সকালেই মার্কিন বিদেশসচিব মার্কো রুবিয়ো বলেছিলেন, “আমাদের (ভারত এবং আমেরিকার) বোঝাপড়ার ভিত্তি হল দুই দেশের দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক। আমরা উপলব্ধি করতে পেরেছি যে, আমাদের অর্থনৈতিক সম্পর্কে দারুণ সম্ভাবনা রয়েছে।” তার পরেই এমন বার্তা এল ট্রাম্পের তরফে।
আরও পড়ুনঃ লাল পতাকার রাষ্ট্রীয় গাড়ি! কমিউনিস্ট নেতাদের জন্য তৈরি গাড়িতে চড়লেন মোদী
ট্রাম্পের শুল্কনীতি রাশিয়া, ভারত এবং চিনকে আরও কাছাকাছি এনে নয়া ত্রিদেশীয় অক্ষ গঠনের সম্ভাবনা উস্কে দিয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। আমেরিকার আপত্তি সত্ত্বেও রাশিয়া থেকে অশোধিত তেল কেনা অব্যাহত রাখায় ট্রাম্প ভারতীয় পণ্যের উপর জরিমানা-সহ ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন। এই আবহে আগামী রবি ও সোমবার (৩১ অগস্ট-১ সেপ্টেম্বর) চিনের বন্দর শহর তিয়ানজ়িনে এসসিও (শাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজ়েশন)-র শীর্ষসম্মেলনে যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। রবিবার জিনপিং এবং সোমবার পুতিনের সঙ্গে পার্শ্ববৈঠকও করেন তিনি।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন, এ বারের এসসিও বৈঠকে ‘রাশিয়া-ভারত-চিন ত্রিশক্তি জোট’ বা ‘রিক ট্রয়িকা’ (রাশিয়া-ইন্ডিয়া-চায়না ট্রয়িকা) দানা বাঁধার সম্ভাবনা তৈরি করেছে। যা ওয়াশিংটনের পক্ষে উদ্বেগের হতে পারে। মস্কোর সঙ্গে নয়াদিল্লির ঘনিষ্ঠতা গত অর্ধশতকের বেশি পুরনো। নতুন করে আমেরিকার উপর চাপ বাড়াতে পারে গালওয়ানের রক্তাক্ত সংঘাত পিছনে ফেলে ভারত-চিন মৈত্রী। বিশেষত এসসিও শীর্ষ সম্মেলনের যৌথ বিবৃতিতে পহেলগাঁও হত্যাকাণ্ডের উল্লেখ ইঙ্গিতবাহী বলে মনে করছেন তাঁরা। এই আবহে ট্রাম্পের মন্তব্য তাৎপর্যপূর্ণ।
প্রধানমন্ত্রী মোদী সঙ্গে বৈঠকের পরে সোমবার ইউক্রেন সঙ্কট মেটাতে ভারত এবং চিনের ভূমিকার দরাজ প্রশংসা করেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। একই সঙ্গে সাড়ে তিন বছর ধরে চলা রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য দু’টি কারণকে দায়ী করেন তিনি। এসসিও শীর্ষসম্মেলনে বক্তৃতা করার পরেই মোদীর সঙ্গে পার্শ্ববৈঠকের জন্য রওনা দেন পুতিন। একই গাড়িতে সওয়ার হয়ে বৈঠক করতে যান দুই রাষ্ট্রপ্রধান। ভারতীয় সময় বেলা ১২টার কিছু পরে মোদী এবং পুতিনের দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয়।
তার আগে এসসিও সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে বক্তব্য পেশ করেন রুশ প্রেসিডেন্ট। সেখানেই তিনি বলেন, ‘‘ইউক্রেন সঙ্কট মেটাতে চিন এবং ভারতের ভূমিকার প্রশংসা করছি আমরা।” কয়েক দিন আগেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অন্যতম পরামর্শদাতা পিটার নাভারো ইউক্রেন যুদ্ধকে ‘মোদীর যুদ্ধ’ বলে দাবি করেছিলেন। নিজের বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ভারত রাশিয়া থেকে তেল কিনছে বলেই ওই টাকা ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঢালতে পারছে মস্কো। সোমবার অবশ্য পুতিন এই দাবি নস্যাৎ করে জানিয়েছেন, আমেরিকার নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট নেটো আর পশ্চিমি দুনিয়া হস্তক্ষেপ করার জন্যই এই যুদ্ধ শুরু হয়। তবে একই সঙ্গে ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে ট্রাম্পের উদ্যোগেরও প্রশংসা করেন পুতিন। এই প্রসঙ্গে ১৫ অগস্টের আলাস্কা বৈঠকের কথাও উল্লেখ করেছেন তিনি। পুতিন বলেন, “আমি এটাও বলতে চাই যে সম্প্রতি আলাস্কায় রাশিয়া এবং আমেরিকার বৈঠকে একটা বোঝাপড়া হয়। আমার মনে হয়, নির্দিষ্ট লক্ষ্যপূরণে তা কাজ করবে।” কী সেই বোঝাপড়া এবং লক্ষ্য, তা এ দিনও খোলসা করেননি তিনি।
আরও পড়ুনঃ ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা বেড়ে হল ৬১০, আহত বহু! চলছে জীবিতদের খোঁজ ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে
ভারতীয় পণ্যের উপর ৫০ শতাংশ শুল্ক চাপানোর যৌক্তিকতা নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন তুলেছে আমেরিকার বিরোধী দল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি। ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক-সিদ্ধান্তকে সরাসরি ‘ভারত-মার্কিন সম্পর্কে অন্তর্ঘাত’ বলে। বিষয়টি আমেরিকার কংগ্রেসের বিদেশ বিষয়ক কমিটিতে বিতর্কও হয়েছে ইতিমধ্যেই। বারাক ওবামা-জো বাইডেনদের দলের প্রশ্ন, ইউক্রেন যুদ্ধের আবহে রাশিয়া থেকে চিন দেদার তেল কেনা সত্ত্বেও তাদের বিরুদ্ধে কেন কোনও শাস্তিমূলক শুল্ক আরোপ করা হল না? এই আবহে ভারত-মার্কিন বাণিজ্যের তথ্য-পরিসংখ্যান তুলে ট্রাম্পের বিবৃতি ‘ঘরোয়া রাজনীতিতে বিতর্ক প্রশমনের সাফাই বলে মনে করছেন অনেকেই।
প্রসঙ্গত, বাণিজ্যচুক্তি নিয়ে আলোচনার মধ্যেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত ৩০ জুলাই ভারতের উপর ২৫ শতাংশ শুল্ক চাপানোর কথা ঘোষণা করেছিলেন। একই সঙ্গে রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্কের কারণে অতিরিক্ত ও অনির্দিষ্ট একটি ‘জরিমানা’ (পেনাল্টি)-র কথাও জানিয়েছিলেন ট্রাম্প। এর পরে গত ৬ অগস্ট ট্রাম্প ভারতীয় পণ্যে ২৫ শতাংশ শুল্কের উপর আরও ২৫ শতাংশ জরিমানা (অর্থাৎ মোট ৫০ শতাংশ) আরোপ করার কথা ঘোষণা করেন। যা ব্রাজিল ছাড়া অন্য সমস্ত দেশের উপর আরোপিত মার্কিন শুল্কের মধ্যে সর্বোচ্চ। গত ২৭ অগস্ট থেকে সেই শাস্তিমূলক শুল্ক কার্যকর হয়েছে। ট্রাম্পের এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আমেরিকার অন্দরেও প্রতিবাদ উঠতে শুরু করেছে ইতিমধ্যেই।
চলতি বছরেই কোয়াড (ভারত-আমেরিকা-জাপান-অস্ট্রেলিয়া চতুর্দেশীয় অক্ষ) শীর্ষসম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য ভারতে আসার কথা ছিল আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের। কয়েক মাস আগে মোদী তাঁকে আমন্ত্রণও জানিয়েছিলেন। সে সময় ট্রাম্প রাজি হয়েছিলেন ভারতে আসতে। কিন্তু তাঁর সেই সফর বাতিল হয়ে গিয়েছে বলে খবর। মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইম্সের (এনওয়াইটি) একটি রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, ট্রাম্প এ বছর ভারতে না-আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কোয়াড সম্মেলনে তিনি হয়তো যোগ দেবেন না। যদিও ওয়াশিংটন বা নয়াদিল্লির তরফে এ বিষয়ে এখনও কোনও মন্তব্য করা হয়নি।
মূলত ভারত-প্রশান্তমহাসাগরীয় অঞ্চলে চিনের প্রভাববৃদ্ধি রুখতে আমেরিকার উদ্যোগে তৈরি হয়েছিল কোয়াড। প্রতি বছর কোনও না কোনও সদস্য রাষ্ট্রে এই গোষ্ঠীর বার্ষিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এ বছর কোয়াডের সম্মেলন হওয়ার কথা ভারতে। সেই মতো সদস্য দেশগুলির প্রধানদের কাছে মোদীর আমন্ত্রণ গিয়েছে। গত জুনে নয়াদিল্লি জানিয়েছিল, কোয়াডের জন্য মোদীর আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন ট্রাম্প। যথাসময়ে তিনি ভারতে আসবেন। কিন্তু ট্রাম্পের সূচি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, এমন সূত্র উল্লেখ করে শনিবার নিউ ইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, ভারতে আসার কোনও পরিকল্পনা এখন আর নেই মার্কিন প্রেসিডেন্টের। এ ছাড়া এই রিপোর্টে মোদী এবং ট্রাম্পের মধ্যে একটি ফোনালাপের কথাও তুলে ধরা হয়েছে। গত জুনে ৩৫ মিনিটের সেই ফোনালাপ থেকেই নাকি বিতর্কের সূত্রপাত। তার পর থেকেই মোদী এবং ট্রাম্পের মধ্যে সম্পর্কে শীতলতা বেড়েছে।