নামটা উচ্চারণ করলেই যেন আলো ঝলমলে এক পর্দা খুলে যায়— শাহরুখ খান। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে এই নাম শুধু এক অভিনেতার নয়, এক অনুভূতির, এক আশ্রয়ের। তাঁর হাসি, চোখের চাহনি, দু’হাত মেলে ধরা সেই পেটেন্ট ভঙ্গি— সব কিছুই যেন এক অদ্ভুত মন্ত্র, যা কোটি হৃদয়ে আজও অনুরণিত। তবু বাদশাহর রাজপথ সবসময় আলোয় ভরা ছিল না। লাইট, রেড কার্পেট আর করতালির ঝলকানির আড়ালে ছিল অনেক অন্ধকার অধ্যায়, যেখানে ভারতের সবচেয়ে বড় তারকা হেরে গিয়েছিলেন— ব্যর্থতার ধাক্কায়, সমালোচনার তীব্রতায়। তবু শাহরুখ থামেননি কখনও। পড়ে গিয়েও তিনি হাঁটতে শিখেছেন, হারিয়েও ফিরে এসেছেন আরও উজ্জ্বল আলোয়।

১৯৯৩ সালে ‘কিং আঙ্কল’— জ্যাকি শ্রফের সঙ্গে পারিবারিক গল্পে তৈরি সেই ছবি হারিয়ে গেল বাণিজ্যিক স্রোতে। তারপর ১৯৯৫ সাল, এক বছরে সাতটি ছবি— এক অভিনব রেকর্ড। ‘করণ অর্জুন’, ‘দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে যায়েঙ্গে’— একের পর এক সাফল্য। দর্শক যেন পাগল হয়ে যাচ্ছিল তাঁর প্রেমে। কিন্তু ঠিক তখনই এল এক ধাক্কা, যা বদলে দিল অনেক কিছু— ‘ত্রিমূর্তি’।
মুকুল আনন্দ পরিচালিত ছবিতে শাহরুখের সঙ্গে ছিলেন জ্যাকি শ্রফ ও অনিল কপূর। প্রযোজক সুভাষ ঘাই ১১ কোটি টাকায় তৈরি করেছিলেন ছবিটি— যা তখনকার ভারতের সবচেয়ে ব্যয়বহুল চলচ্চিত্র। প্রথম দিনেই এক কোটি টাকার ব্যবসা, শুরুটা ছিল রাজকীয়। কিন্তু রিভিউ ভয়ানক খারাপ, মুখে মুখে কটাক্ষ, আর দুই সপ্তাহের মধ্যেই প্রেক্ষাগৃহ থেকে উধাও ‘ত্রিমূর্তি’। শেষমেশ আয় দাঁড়াল মাত্র ৯ কোটিতে— বাজেটেরও নিচে। একসময়ের ‘ডিডিএলজে’-র রোম্যান্টিক নায়ক হঠাৎই পরিণত হলেন সবচেয়ে বড় ফ্লপস্টারে।
আরও পড়ুনঃ প্রিয় গোল্ডি উধাও! থানায় মহিলা; অপরাধ বাড়ছে শিলিগুরিতে
এই ছবিটিই হয়ে রইল মুকুল আনন্দের শেষ কাজ। ‘অগ্নিপথ’, ‘খুদা গওয়াহ’, ‘হাম’-এর মতো কালজয়ী ছবির স্রষ্টা ১৯৯৭ সালে শ্যুটিং চলাকালীন হার্ট অ্যাটাকে চলে গেলেন না ফেরার দেশে।

‘ত্রিমূর্তি’ হারিয়ে গেল বক্স অফিসে, আর এক অধ্যায় শেষ হল সিনেমার ইতিহাসে। শাহরুখ অবশ্য থামেননি। পরের বছরগুলোতে তিনি আরও বেশি করে কাজ করেছেন, যেন ব্যর্থতার জবাব দিতে চান নিজের কাজের মাধ্যমেই। বিবিসির টকিং মুভিজ অনুষ্ঠানে একবার বলেছিলেন— “আমরা খারাপ সিনেমা বানিয়েছিলাম, এইটুকুই সত্যি। তুমি একটা গল্প বলতে চাও, কখনও সেটা ভালোভাবে বলতে পারো, কখনও পারো না। ব্যর্থতার কোনও রহস্য নেই— আমি গল্পটা ঠিকমতো বলতে পারিনি, এই তো।” সেই অকপট স্বীকারোক্তি আজও প্রমাণ করে, শাহরুখ কখনও নিজের ভুলকে আড়াল করেননি, বরং সেখান থেকেই শিখেছেন কীভাবে নিজেকে আরও ভালো করতে হয়।
২০০১ সালে এল ‘অশোকা’। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বানানো এই ছবিতে শাহরুখ এক নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন— রাজপুত্র থেকে সম্রাট, যুদ্ধ থেকে প্রেম— সব কিছু একসঙ্গে। সৌন্দর্যে ভরপুর ছবিটি দর্শক তেমন গ্রহণ করল না। ‘অশোকা’ হয়ে গেল এক ব্যর্থ ইতিহাস। এরপর ২০০৫ সালে ‘পহেলি’— এক প্রেমে পাগল ভূতের গল্প, যা ভারতের অস্কার মনোনীত হয়েও বাণিজ্যিক সাফল্য পায়নি। ২০১১ সালের ‘রা.ওয়ান’— তাঁর প্রযোজনা জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন, ভারতের সবচেয়ে ব্যয়বহুল সুপারহিরো সিনেমা, কিন্তু গল্প হারিয়ে গেল প্রযুক্তির ঝলকানিতে।
আরও পড়ুনঃ ভয়ঙ্কর কাণ্ড! একাধিক ব্যক্তিকে ছুরির কোপ, কামরার মেঝে ভাসল রক্তে, হামলা চলন্ত ট্রেনেই
বছর কয়েক পর এল ২০১৬-এর ‘ফ্যান’— যেখানে শাহরুখ অভিনয় করলেন নিজেরই ভক্ত ও নিজের চরিত্রে। সিনেমাটি ছিল ঝুঁকিপূর্ণ, গভীর, আত্মসমালোচনামূলক। অনেকেই বললেন, এটি তাঁর কেরিয়ারের সবচেয়ে সাহসী কাজ, কিন্তু সাধারণ দর্শক সেই সাহসের জন্য তখনও প্রস্তুত ছিলেন না। বক্স অফিস মুখ ফিরিয়ে নিল। ২০১৮-তে ‘জিরো’— খর্বাকৃতি এক প্রেমিকের গল্পে তিনি নিজেকে ভাঙলেন, গড়লেন, কিন্তু সাফল্য আসেনি। সমালোচনার ঝড় উঠল, কেউ কেউ বললেন, “শাহরুখের ম্যাজিক শেষ।”
কিন্তু শাহরুখ ছিলেন নীরব। সেই নীরবতা সবচেয়ে তীব্র হয়েছিল একদিন— যখন তিনি ছেলেকে দেখতে গেলেন জেলে। শত ফ্ল্যাশ, হাজার চোখ, প্রচণ্ড কোলাহলের মাঝে এক নীরব মানুষ মাথা নত করে প্রণাম জানাচ্ছেন সবাইকে। না, সেটি কোনও শুটিং ছিল না— সেটি ছিল এক বাবা, এক মানুষ, যিনি নিজের মর্যাদা ধরে রাখলেন চুপ করে থেকেও। সেই মুহূর্তে শাহরুখ যেন নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করলেন— রাজা মানে শুধু সাফল্য নয়, মর্যাদাও।

এরপর সময় বদলালো। ২০২৩— এক রাজকীয় প্রত্যাবর্তন। ‘পাঠান’, ‘জওয়ান’, ‘ডাঙ্কি’— একের পর এক ছবিতে যেন নতুন করে লিখলেন নিজের রাজকীয় গল্প। বক্স অফিস ভাঙলেন, রেকর্ড গড়লেন, কিন্তু এবার আর তাঁর চোখে সেই পুরনো তেজ ছিল না— ছিল এক শান্ত আত্মবিশ্বাস, এক পরিণত নীরবতা।
ষাটে পা দিয়েছেন শাহরুখ খান। বয়স তাঁর কাছে কেবল একটি সংখ্যা। এই দীর্ঘ পথচলায় তিনি ছুঁয়েছেন সাফল্যের চূড়া, নেমেছেন ব্যর্থতার অতলে, আবার উঠেছেন আগের চেয়ে উজ্জ্বল হয়ে। তাঁর ফ্লপ ছবিগুলো ছিল না ব্যর্থতা— ছিল শেখার ধাপ। প্রতিটি হোঁচট তাঁকে আরও শক্ত করেছে, আরও মানবিক করেছে। তিনি বারবার প্রমাণ করেছেন, সিনেমা তাঁর কাছে ব্যবসা নয়— মানুষের সঙ্গে এক অবিরাম সম্পর্ক।
শাহরুখ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “এখন থেকে আমার কেরিয়ার শুধু অভিনয়ের জন্য। আমি হয়তো ২০০ কোটির ক্লাবে ফিরব না, কিন্তু অভিনয়ে ফিরব আরও গভীরে।” তিন দশকের এই দীর্ঘ পথচলায় তিনি ছুঁয়েছেন সাফল্যের চূড়া, আবার নেমেছেন ব্যর্থতার অতলেও। কিন্তু তাঁর চোখে এখনও সেই জেদ, সেই আগুন। তারপরের সাফল্যের কথা আর না-ই বা বলা হল শুধু এটুকু বলা থাক, যখন জওয়ান-এর জন্য তিনি জাতীয় পুরস্কার হাতে নেন, ফ্যানদের মুখে একটাই কথা— “এবার যেন মরেও শান্তি।”
ষাটে পা দিলেন খান— একসময় যাঁকে কেউ বলত ‘ফ্লপস্টার’। আজও তিনিই ভারতের সবচেয়ে বড় সুপারস্টার। কারণ রাজত্ব টিকে থাকে না চিরকাল, কিন্তু রাজারা টিকে থাকেন—মনের রাজা হয়ে।





