নেপালে জেন জি-র গণঅভ্যুত্থান প্রায় শেষের পথে। টুকরো টাকরা হিংসা চলতে থাকলেও এবার সরকার বদলের পর নয়া সরকার গঠনের পালা। কিন্তু, মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এই গৃহযুদ্ধের নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ল কে? কোন শক্তির অঙ্গুলি হেলনে, উসকানি এবং নোটের তাড়ায় রাতারাতি পতন ঘটল সরকারের? নেপালে প্রকৃত অর্থে ‘নেপো কিড’ বা ‘নেপো বয়’ আন্দোলনের আড়াল থেকে ‘নেপোয় মারে দই’ কে খেয়ে গেল, এই প্রশ্নটিই এখন সকলের মনের আনাচেকানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে কিছুটা পিছু হেঁটে যেতে হবে। নয়ের দশকে ব্রিটিশ লেখক ফ্রেডরিক ফরসাইথের লেখা ‘আইকন’ উপন্যাসের প্লট নিয়ে তৈরি হয়েছিল একটি বিখ্যাত টিভি থ্রিলার। যার সারবস্তু ছিল, পশ্চিমী মদতপুষ্ট শক্তিগুলি কীভাবে জমানা বদল করে দিতে পারে, যে জমানা তাদের কিংবা আন্তর্জাতিক নিয়মনীতির নির্দেশ অমান্য করে চলে।
আরও পড়ুনঃ Gen Z ঘুরে গেল ১৮০ ডিগ্রি; বিক্ষোভ..তাণ্ডব..আগুন এসব কিছুই নাকি করেনি Gen Z
ঘটনাটি ছিল এই রকম যে, ব্রিটিশ আন্তর্জাতিক গুপ্তচর বাহিনী এমআই সিক্সের প্রাক্তন এক দুঁদে চর প্রাক্তন এক সিআইএ চরকে রাশিয়ার গতিবিধি নজরদারিতে নিয়োগ করেন। যার লক্ষ্য ছিল ক্রেমলিনে শক্তিশালী রাজনৈতিক চক্রের উত্থানকে ভিতর থেকে নষ্ট করা। উপন্যাসের প্লটে পরিকল্পনার মধ্যে ছিল রাশিয়া জারতন্ত্র ফিরিয়ে এনে স্থায়িত্ব গঠন। কারণ জারতন্ত্রের অবসান ঘটিয়েই কমিউনিস্টরা সমাজতন্ত্র স্থাপন করেছিল সোভিয়েতে অথবা রাশিয়ায়।
একইভাবে নেপালে ২০০৮ সালে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে মাওবাদী ও কমিউনিস্টরা। যদিও সাচ্চা কমিউনিস্টরা গণতন্ত্রে অংশ নিতে পারে না, এই ধারণাকে অমূলক পরিণত করে সেখানে গণতান্ত্রিক-প্রজাতন্ত্র গঠিত হয়। রাজতন্ত্রের পতনের পর থেকে নেপাল কোনওদিন স্থায়ী সরকার পায়নি। একের পর এক ১০ জন প্রধানমন্ত্রী বদল হলেও নেপালে জমানার পরিবর্তন আসেনি।
তাই সদ্য ঘটে যাওয়া জেন জি-র এই গণঅভ্যুত্থানের একটা বিরাট প্রশ্ন জেগেছে, এই বিপ্লব কি শুধুমাত্র স্বতঃস্ফূর্ত নাকি একটি বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের ভাগীদার। এক জনপ্রিয় সমাজকর্মী ২০২৪ সালেই ট্যুইটে লিখেছিলেন নেপালে খুব শীঘ্রই রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে দাবি উঠবে এবং তা ক্রমে ক্রমে বিরাট আকার নেবে। অনেকের ধারণা, এই অস্থিরতা হল দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে সরকার পতনের নেপথ্যে এক গভীর ষড়যন্ত্র। যেমন- শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মায়ানমার ও সবশেষে নেপাল, কয়েক বছরের মধ্যে এই দেশগুলিতে সরকার ফেলে দেওয়া হয়েছে। কেউ কেউ মজা করে একে ‘সরকার পতনের এশিয়া কাপ’ বলেও মন্তব্য করছেন। আবার কেউ বলেছেন, রাস্তায় নেমে গণআন্দোলনের এই রূপ কি আদৌ স্বতঃস্ফূর্ত!
আরও পড়ুনঃ দেশ জুড়ে জারি কার্ফু, নেপালের শাসনভার সেনার হাতে
নেপালের একটি বিরাট অংশের যুবশ্রেণির দাবি রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনা ও হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের। কারণ অনেকেরই ভিতর থেকে গণতন্ত্রের অন্তঃসারশূন্য ও স্বজনপোষণ, দুর্নীতির কঙ্কালটি প্রকট হয়ে উঠেছে। আর তাতেই ধুনো দিয়ে চলেছে কারা। পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা থেকে নেপাল পর্যন্ত কোন চরবাহিনী এই আন্দোলনগুলিকে পরিচালনা করছে। যার শুরুই হয়েছিল নেপো কিড প্রচারের মধ্য দিয়ে। রাজনৈতিক নেতাদের ছেলেমেয়েরা কীভাবে রাজকীয় চালে থাকে। তাদের বিদেশে পড়াশোনা, বিলাসবহুল বিদেশি গাড়ি, ছুটি কাটানোর প্রমোদ বাংলো। আর অন্যদিকে, সাধারণ যুবসমাজের দারিদ্র্যের সঙ্গে লাগাতার লড়াই, বেকারির জ্বালায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে অত্যন্ত সুচারুভাবে।
নেপো বেবিদের একটি ভিডিও দেখে উত্তাল হয়ে ওঠে জনতা। সংখ্যাতত্ত্ব বলছে, গত এক বছরে প্রায় ৭,৪০,০০০ নেপালি কাজের খোঁজে অন্য দেশে চলে গিয়েছে। ফলে এখন অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করছেন যে, এই আন্দোলন ভিতর থেকে উঠে এসেছে নাকি তৈরি করা হয়েছে? রেডিট-ট্যুইটারে ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে এটা পুরোপুরি মার্কিন চর বাহিনীর মদতে ‘কালার রেভেলিউশনের’ অঙ্গ। কালার রেভেলিউশন হল সোভিয়েতের পতনের পর থেকে একটি একটি মার্কিন ষড়যন্ত্র, যা অহিংস জন আন্দোলনের মধ্য দিয়ে কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটায়। বিশেষত চিন-বান্ধব নেপালে অস্থিরতা সৃষ্টি করার চেষ্টা। আবার কেউ কেউ মনে করছেন, এর পিছনে হাত রয়েছে বেজিংয়ের। কারণ সোশ্যাল মিডিয়া নিষিদ্ধ করার সময় কেবলমাত্র পশ্চিমী সোশ্যাল মিডিয়াগুলিই নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, খোলা ছিল চিনের টিকটক।
ফলে শেষমেশ এখনও বোঝা যাচ্ছে না যে, এই আন্দোলন সত্যিকারের গণমুখী নাকি একেবারে রাসায়নিক সার প্রয়োগ করে রাতারাতি বাড়িয়ে দেওয়া কোনও চক্রান্ত। তাই নেপালে যে সমুদ্রমন্থনের মতো উথালপাতাল রাজনীতি চলছে, তার পিছনে চিন ও আমেরিকার ছায়াযুদ্ধ কতখানি চলছে তা অজ্ঞাতই থেকে যাবে। ঘটনা যে দিকেই গড়াক তা যে ভারতের পক্ষে মঙ্গলজনক হবে না, তা একশোভাগ সত্যি। শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, পাকিস্তানের পর হিমালয়ের কোলে ছোট্ট পাহাড়ি রাষ্ট্র নেপালও যদি চিন বা আমেরিকার কাঠের পুতুল হয়ে যায়, তাহলে অবশ্যই তা বিশ্বগুরুর ঘুম উড়িয়ে দেবে