১৯৯৭ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত তাঁকে কাছ থেকে দেখেছেন, বোঝার চেষ্টা করেছেন। পরের বছর অর্থাৎ ২০০৫ সালে প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে নিয়ে তথ্যচিত্র ‘জ্যোতি বসুর সঙ্গে’ বানিয়েছিলেন গৌতম ঘোষ। দেখতে দেখতে পার হয়ে গিয়েছে তার ২০ বছর। মঙ্গলবার, জ্যোতি বসুর জন্মদিনে সে কথা তুলতেই স্মৃতিমেদুর ‘পার’, ‘পদ্মানদীর মাঝি’র মতো ছবির পরিচালক।
“ভীষণ সাদামাঠা। নিপাট ভদ্রলোক, লাজুক। নিজের জুতো নিজে পলিশ করতেন। সেই মানুষটিই রাজনীতির ময়দানে প্রবল পরাক্রমী”, বঙ্গবার্তার কাছে স্মৃতি উজাড় করলেন গৌতম। এর আগে বিসমিল্লা খান, দলাই লামাকে নিয়ে তথ্যচিত্র বানিয়েছিলেন গৌতম। তার পরেই তিনি বেছে নেন জ্যোতি বসুকে। গৌতম বলেন, “দেখলাম, সেই সময়ে জ্যোতিবাবুর মতো অভিজ্ঞ ব্যক্তি দ্বিতীয় কেউ নেই। তাই ওঁকেই তথ্যচিত্রে ধরে রাখার সিদ্ধান্ত নিলাম। কাজের খাতিরে ১৯৯৭ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত ওঁকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। তবে টানা তাঁর সঙ্গে থাকিনি।”
আরও পড়ুন: প্লাবন হাওড়া-হুগলিতে! জল ছাড়ার পরিমাণ বাড়াল DVC
সাল ১৯৯৭, ফরাক্কা-পদ্মা চুক্তি নিয়ে বাংলদেশের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে যোগ দিতে জ্যোতিবাবু গিয়েছিলেন ও পার বাংলায়। সফরসঙ্গী গৌতম ঘোষ। বৈঠকের পর প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী দেশের বাড়িতে গিয়েছিলেন। তত দিনে তাঁর বাড়িটি বাংলাদেশ সরকার সংরক্ষণ করে ফেলেছিল।
পরিচালকের কথায়, “সে এক দারুণ অভিজ্ঞতা। দেশের বাড়িতে গিয়ে ওই দোর্দণ্ডপ্রতাপ মানুষটি যেন ছেলেমানুষ হয়ে গেলেন। বাংলাদেশ নদীমাতৃক। তাই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে গেলে লঞ্চে উঠতে হত। জ্যোতিবাবু বলেছিলেন, ‘লঞ্চের পাতলা মুরগির ঝোলের যে কী স্বাদ! না খেলে বোঝা সম্ভব নয়’।”
তথ্যচিত্র পরিচালনার কারণে এমন নানা অনুষ্ঠানে, উদ্যাপনে জ্যোতিবাবুর সঙ্গে থাকার সুযোগ হয়েছিল পরিচালকের। যদিও তিনি সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হননি। জানিয়েছিলেন অবসর নেওয়ারই পর সাক্ষাৎকার দেবেন গৌতমকে।
তাঁর থেকে বয়সে ছোটদেরও ‘আপনি’ সম্বোধন করতেন, জ্যোতিবাবু। ছিলেন অত্যন্ত নিয়মনিষ্ঠ। অবসরের পর জ্যোতিবাবু গৌতমকে ‘ঐতিহাসিক ভুল’ নিয়ে নিজের অনুভূতি জানিয়েছিলেন। দলের আপত্তিতেই তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ হারান। প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর কি তাই নিয়ে কোনও ক্ষোভ ছিল? গৌতমের দাবি, “অবশ্যই ছিল। তিনি আফসোস করেছিলেন, ‘দলের আপত্তিতে প্রধানমন্ত্রী হতে পারলাম না। ইচ্ছে ছিল সার্বভৌম গণতান্ত্রিক দেশ গড়ার। বাম দল কেন্দ্রে সরকার গড়লে সেটাই হত’।”
আরও পড়ুন: মঙ্গলে কোনও অমঙ্গল, শুক্লা ত্রয়োদশীতে সারাদিন ব্রহ্মা যোগ, ভাগ্যে চমক লাগবে
গৌতমের স্মৃতিতে উঠে আসে জ্যোতিবাবুর স্ত্রী কমল বসুর কথাও, “তিনি ছিলেন পাক্কা মেমসাহেব! দুর্দান্ত কন্টিনেন্টাল রান্না করতেন। অথচ বিদেশে পড়াশোনার পরেও প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন অন্তর থেকে বাঙালি।” রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়ার পরে একটি বড় টিফিন বাক্সে তাঁর খাবার রাখা থাকত। খুব সাদামাঠা খেতেন। কোনও বাহুল্য বা বায়না ছিল না।
চলচ্চিত্র বা শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অনেক বেশি আগ্রহী ছিলেন জ্যোতিবাবু উত্তরসূরি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। জ্যোতিবাবুর কি সাংস্কৃতিক দুনিয়ার প্রতি আগ্রহ কম ছিল? গৌতম বলেন, “জ্যোতিবাবু বিনোদন বা সাংস্কৃতিক দুনিয়া সম্বন্ধে বেশি খবর রাখতেন না। তবে বললে বোঝার চেষ্টা করতেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, তিনি লেখাপড়া শিখেছেন। তাই বোঝালে বুঝবেন না— এমন কোনও বিষয় নেই।”
সম্প্রতি রাজ্য সিপিএম জ্যোতি বসুর জীবনীছবি বানানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। খবর, টলিউডের পাশাপাশি বলিউডের একাধিক পরিচালক নাকি রাজ্য সিপিএমের সঙ্গে যোগাযোগ করে ছবি পরিচালনার ইচ্ছার কথা জানিয়েছেন। সব ঠিক থাকলে এ বছরের শেষে অথবা আগামী বছরে শুরুতে জীবনী ছবি বানানোর কাজ শুরু হতে পারে। গৌতম কি আগ্রহী?
পরিচালকের কথায়, “সে রকম কোনও কথা আমার সঙ্গে হয়নি। তবে আমার তথ্যচিত্রটি যাতে ডিজিটাইজ়ড হয় তার আবেদন দলীয় নেতৃত্বের কাছে রেখেছি।” ‘জ্যোতি বসুর সঙ্গে’ তথ্যচিত্রটিই প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর জীবদ্দশায় তৈরি একমাত্র প্রামাণ্য দলিল।