বুদ্ধবাবু আপনি কি শুনছেন ?
ব্রাউন ব্রেড, বাটার, এগ হোয়াইট আর মিক্সড ফ্রুট জুইস সহ ডাইনিং টেবিলে ব্রেকফাস্ট করার সময় ইকোনমিক টাইমস পড়তে পড়তে পেশাতে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার আমার বন্ধু বলে ওঠে – ‘‘৩৪ বছরে বামেরা কিছুই করেনি”। আমার বন্ধু সল্টলেক টেকনোপলিসের ‘কগনিজেন্ট’-এর অফিসে চাকরি করে। মাস গেলে বেশ মোটা অঙ্কের বেতন, শহরের বুকে ৩ বিএইচকে ফ্ল্যাটে অত্যাধুনিক ফার্নিচার, দামি গাড়ি চেপে স্ত্রী আর ছেলে-মেয়ে কে নিয়ে সপ্তাহান্তে অন্তত একবার ‘আইনক্স’-এ সিনেমা দেখে ফেরার পথে ‘ম্যাকডোনাল্ড’-এ ঢুঁ মারা আর বাড়ি ফিরে এসে হালকা করে এসি-টা ছেড়ে দিয়ে দামি সোফায় বসে বিশাল বড় এলসিডি টিভির সামনে বসে ‘কমিউনিস্ট’-দের সমালোচনা করে গুষ্টি উদ্ধার না করলে পেটের ভাতটা ঠিক হজম হয় না, রাতের ঘুমটা ঠিক গাঢ় হয় না, মনের কোণে ঠিক একটা আত্মতৃপ্তির পূর্ণতা মেলে না। এই তো জীবন কালিদা, সকাল বিকেল ‘কমিউনিস্ট’-দের সমালোচনা করে পাড়া মাথায় না তুললে ও জিন্দেগী জিন্দেগী নেহি হ্যা কালিবাবু, ও কুচ ওর ই হ্যা।
আরও পড়ুনঃ ছাত্র সংসদ ভোট নিয়ে আদালত-নিদান, বিজ্ঞপ্তি জারি করুন, বাকি কোর্ট দেখে নেবে
হাওড়া থেকে হনুলুলু, নেটফ্লিক্স থেকে নিমাই-এর চায়ের দোকান, ডালগোনা কফি থেকে শুরু করে মুসুর ডালের দাম সবকিছুই নখদর্পনে রাখলেও আমার বন্ধু শুধু জানেনা ২০০০ সালের ২৬ নভেম্বর সল্টলেকে দ্বিতীয় টেকনোলজি পার্কের উদ্বোধন হোক বা ২০০১ সালের ৬ নভেম্বর মহাকরণে ‘আইবিএম’-এর সাথে চুক্তি সম্পাদন হোক অথবা ২০০২ সালের ২৬ জুন ‘উইপ্রো’র চেয়ারম্যান আজিম প্রেমজির সাথে চুক্তি সাক্ষর কিম্বা ২০০৩ সালের ১১ জুলাই বিধাননগরে ‘কগনিজেন্ট টেকনোলজি সলিউনে’র নতুন কমপ্লেক্সের উদ্বোধন অথবা বা ওই একই বছরের ৯ অক্টোবর রাজারহাটে অত্যাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি পার্ক ও পরিকাঠামো গড়তে মহাকরণে চুক্তি-সই কিম্বা বা ২০০৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি মহাকরণে ‘আইবিএম’-এর প্রতিনিধিকে রাজি করিয়ে রাজ্যে আরো একটি ‘আইবিএম’-র অফিস খুলতে চুক্তি সাক্ষর বা ঠিক তার পরের দিন ৩ ফেব্রুয়ারি ক্যামাক স্ট্রিটে তথ্য প্রযুক্তি দপ্তরের অফিস উদ্বোধন বা ওই বছরের ১৯ নভেম্বর বিধাননগরে ‘উইপ্রো’র কলকাতা ডেভেলপমেন্ট সেন্টার উদ্বোধন করার সময় ‘উইপ্রো’র চেয়ারম্যান আজিম প্রেমজি এর সাথে চুক্তি সাক্ষর করা যে রাজ্যে ‘উইপ্রো’র আরো বিনোয়োগ হবে অথবা বা ওই একই বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর গ্রিন আই পার্ক ‘টেকনোপোলিস’-এর উদ্বোধন বা ২০১০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর নোনাডাঙায় আইটি পার্কের শিলান্যাস -এই সবকিছুই ওই একটা ৩৪ বছরের সরকারের আমলেই হয়েছিল ওই একজন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নামক মানুষের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময়েই হয়েছিল।
২০০৫-০৬ সালে তথ্যপ্রযুক্তিতে রপ্তানি বাবদ পশ্চিমবঙ্গ আয় করেছিল ২৭০০ কোটি টাকা যা সপ্তম বামফ্রন্ট এর শেষের দিকে গিয়ে বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৬,৪০০ কোটি টাকা। ২০০৫-০৬ সালে যেখানে তথ্য প্রযুক্তি তে কাজ করতেন ৩২ হাজার মানুষ তা মাত্র ৩ বছরের মধ্যে বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ। অনুমান ছিল পরবর্তী ৫ বছরের মধ্যে ওই সংখ্যাটি কয়েক লক্ষ হবে। আর এসবই হয়েছিল ওই বুদ্ধবাবুর আমলে একটা বামফ্রন্ট সরকারের আমলে। যদিও আমার বন্ধু এসব খবর রাখেনা,আমার বন্ধু তো এটাও জানেনা বামফ্রন্ট আমলে চুক্তি সাক্ষর হওয়ার পর পরিবর্তনের নতুন বাংলা তে জমি না পেয়ে ইনফোসিস কে আমাদের রাজ্য থেকে পাততাড়ি গোটাতে হয়েছিল অথচ ‘ইনফোসিস’-এর ওই অফিস টি হলে সরাসরি ১০ হাজার আই টি কর্মী চাকরি পেতেন।
বুদ্ধবাবু আপনি কি শুনছেন ?
আমার দাদা স্কুল শিক্ষক। আমার দাদা বাসে-ট্রেনে-ট্রামে-পাড়ার পচাদার চায়ের দোকানে এমনকি বিয়ে বাড়িতে গিয়েও সুযোগ পেলে মানুষজন দের শুনিয়ে দিয়ে আসে- ‘‘৩৪ বছরে বামেরা কিছুই করেনি”। বামফ্রন্ট আমলে সম্পূর্ণ নিজের যোগ্যতাতে কঠোর পরিশ্রম করে রাতদিন পড়াশোনা করে ওই একটা স্কুল সার্ভিস কমিশন এর পরীক্ষাতে পাশ করার পর স্কুল শিক্ষকের চাকরি পাওয়া আমার দাদা হার্দিক পান্ডিয়ার গার্ল ফ্রেন্ড থেকে আমাজন প্রাইম এর ওয়েব সিরিজ, তৈমুরের সারাদিনে প্যান্ট পাল্টানো থেকে গরুর দুধে সোনা পাওয়ার পিএইচডিডি থিসিস সবকিছুর খবর নখদর্পনে রাখলেও শুধু এটুকু খবর রাখেনা যে এই রাজ্যেই একটা সময় প্রতি বছর নিয়ম করে স্কুল সার্ভিস পরীক্ষা হতো। ১৯৯৮’-এ ৮০৭২ জন, ১৯৯৯’-এ ১০৯৮৭ জন , ২০০১’-এ ১২৬৪১ জন, ২০০২’-এ ৯৯৮০ জন, ২০০৪’-এ ৮৬৮৫ জন, ২০০৫’-এ ১৪২৬৭ জন, ২০০৭’-এ ২০৮৮৭ জন, ২০০৮’-এ ১০৯৯৫ জন, ২০০৯’-এ ১২৯৩১ জন, ২০১০’-এ ১৩৬৭৭ জন, ২০১১’-এ ১১৭২৩ জন শিক্ষক শিক্ষিকা নিয়োগ হয়েছিলেন ওই একটা স্কুল সার্ভিস পরীক্ষা দিয়েই।
আরও পড়ুনঃ ‘জনগণ কত সহ্য করবে? সিপি কি মুচলেকা দেবেন?’ ২১ জুলাইয়ের সভা নিয়ে বিরক্ত হাইকোর্ট
বুদ্ধবাবু আপনি কি শুনছেন ?
সিঙ্গুরের কারখানা-টা করতে না দিয়ে লক্ষ লক্ষ ইঞ্জিনিয়ার সহ শিক্ষিত যুবক যুবতীর কবরের মাটি সেদিন এই বাংলার বুকে খোঁড়া হয়ে গিয়েছিলো। আজ এত গুলো বছর পর ব্যাঙ্গালোরের আই টি অফিসে বা নয়ডা, পুনে অথবা আমেদাবাদের কোনো প্ল্যান্টে কাজ করা ওই ইঞ্জিনিয়ার-টা কিম্বা ৭ বছর ধরে আপার প্রাইমারির নিয়োগ আটকে থাকার পর গতকাল পুরো প্রক্রিয়া বাতিল হওয়ায় নিজেদের জীবন থেকে সাত সাতটি বছর নষ্ট হয়ে যাওয়া ওই ছেলে মেয়েগুলো আপনার অভাব ঠিক বুঝছে। আর তা বুঝছে বলেই হয়তো জীবিকার প্রয়োজনে রাজ্য ছেড়ে ব্যাঙ্গালোর অথবা পুনের অফিসে বসে চাকরি করা ওই ছেলেমেয়েগুলো আপনার জন্য দু ফোঁটা চোখের জল ফেলছে, আপনাদের সরিয়ে রাজ্যে পরিবর্তন আনার অনুশোচনা তে প্রতি মুহূর্তে দগ্ধ হচ্ছে।
আসলে সেদিন বামেরা হারেনি, হেরেছিল বাংলার লক্ষ লক্ষ যুবক যুবতীদের স্বপ্ন, হেরেছিল বেকারদের দের কর্মসংস্থান, হেরেছিল জীবিকার জন্য বাইরের রাজ্যে না গিয়ে নিজের রাজ্যেই চাকরি পাবার মনোকামনা, হেরেছিল অনেক স্বপ্ন, অনেক আশা, অনেক ইচ্ছে। হেরেছিল আমি, আপনি রাজ্যের ৯ কোটি মানুষ।
কখনো না কখনো তুমি বুঝবে,
হয়তো আমাকেই খুঁজবে,
মনে পড়বে আমাকে,
মন ভালো না থাকলে।