কুশল দাশগুপ্ত, শিলিগুড়িঃ
বহুদিনের সমস্যা। মেটাতে আগেও চেষ্টা হয়েছে। মেটেনি। তা মেটাতে স্বয়ং মেয়র গৌতম দেব আসরে নামেন। শহরের সমস্ত সাইনবোর্ড বাংলায় লিখতে হবে বলে তিনি একরকম হুঁশিয়ারিই দিয়েছিলেন। তাতেও কাজ হয়নি। মেয়রের সেই কড়া বার্তাকে কোনও আমল না দিয়ে সমস্যা যে-কে-সেই রয়ে গিয়েছে। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হোক বা পাড়ার ছোটখাটো দোকান, বাংলা ভাষাকে আমল না দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্ষেত্রে ইংরেজি বা হিন্দির দারুণ দাপট। এমনকি নানা রাস্তায় দিকনির্দেশের যে সমস্ত সাইনবোর্ড রয়েছে সেগুলিও ইংরেজিতে লেখা। শহরবাসী অবাক। যাঁরা বাংলা ছাড়া অন্য কোনও ভাষা জানেন না, তাঁরা সেই আঁধারেই। নানা সাইনবোর্ডে প্রাণের ভাষাকে জ্বলজ্বল করতে দেখবেন বলে যাঁরা আগেভাগেই বুকের হাপরে সুবাতাস ভরে নিয়েছিলেন তাঁদের প্রশ্বাসে এখন বিষাদের সুর। সমস্যা দ্রুত মিটবে বলে অবশ্য পুরনিগম আশ্বাস দিয়েছে।
আরও পড়ুনঃ মমতা সম্পর্কে দীপক ঘোষের সেই বিতর্কিত বইয়ে নিষেধাজ্ঞা
শহরকে বাংলা ভাষার মোড়কে মুড়ে দিতে হবে বলে নানা সংগঠন বহুদিন ধরেই সরব। তাদের অন্যতম ‘বাংলা পক্ষ’র শিলিগুড়ির সদস্য কৌশিক মাইতি বেশ ক্ষুব্ধ, ‘আসলে এসব মেয়রেরই অবদান। মুখে যাই বলুন না কেন, তিনি আসলে অবাঙালিদের চটাতে কোনওভাবেই রাজি নন। তাই নিজের দেওয়া নির্দেশকে মানা হচ্ছে না দেখেও কোনও ব্যবস্থা নেন না।’ রবিবার বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও মেয়রের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। যতবারই চেষ্টা করা হয়েছে তাঁর মোবাইল ‘ব্যস্ত’ বলেছে। ডেপুটি মেয়র রঞ্জন সরকারের অবশ্য আশ্বাস, ‘সমস্ত সাইনবোর্ড বাংলায় লিখতে হবে বলে ব্যবসায়ীদের মে মাস পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। পরে বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের অনুরোধে সেই সময়সীমা বাড়িয়ে জুলাই মাস পর্যন্ত করা হয়েছে। তবে এরপরও যদি সমস্যা না মেটে তবে কড়া পদক্ষেপ করা হবে।’
অনেকেরই ধারণা, এটি খুব সাধারণ সমস্যা। তা কিন্তু মোটেও নয়। এদিনই হলদিবাড়ি থেকে এনবিএসটিসি’র বাসে শিলিগুড়িতে আসা এক ভদ্রলোককে দেখা গেল এয়ারভিউ মোড়ের কাছে দাঁড়িয়ে শিলিগুড়ি জেলা হাসপাতালের ঠিকানা খুঁজছেন। আশপাশে বাঙালি কাউকে না পেয়ে তাঁর সমস্যা বাড়ছিল। শহরটা অচেনা। অবাঙালি একজন হিন্দিতে কিছু বলায় কিছু বুঝতে পারলেন না। সমস্যা বুঝে উপকারী সেই মানুষ একটি কাগজে দিকনির্দেশ করে কিছু লিখে দিলেও তাতেও সমস্যা মেটেনি। মিটবেই বা কী করে! হলদিবাড়ির মানুষটির তো হিন্দিই জানা নেই। কোনওমতে বিড়বিড় করে বলছিলেন, ‘এলাকাগুলির নাম উল্লেখ করে যদি রাস্তার ধারে কিছু লেখার ব্যবস্থা থাকত তবে হয়তো এই সমস্যায় পড়তে হত না।’ হাতেগোনা কয়েকটি দোকানে বাংলা লেখা এদিন তাঁকে সেভাবে স্বস্তি কিন্তু দিতে পারেনি।
আরও পড়ুনঃ গুগল বন্ধ করল ১১ হাজার ইউটিউব চ্যানেল
তেনজিং নোরগে বাস টার্মিনাস থেকে সেবক রোড বা হিলকার্ট রোডের সমস্ত ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে বলতে গেলে বঙ্গভাষা ব্রাত্যই। কারণটা কী? কমল আগরওয়াল মোবাইল ফোনের ব্যবসা করেন। তাঁর যুক্তি, ‘সবাই যাতে সহজে দোকান খুঁজে পান তাই দোকানের নাম ইংরেজিতে লেখা। তাছাড়া, অনেক খরচ করে সাইনবোর্ড বানিয়েছি। এখন যদি পুরনিগমের নির্দেশ মেনে সবকিছু বাংলায় লিখতে যাই তবে অনেক খরচ হবে।’ কমলের সুরে ব্যবসায়ীদের আরও অনেকে সরব হন। আর অবাক করার বিষয় বলতে, তাঁদের একটা অংশ বাঙালি। শিলিগুড়ি কলেজের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক অমল রায়ের মতো অনেকেরই মন খারাপ, ‘সাইনবোর্ডে অন্যান্য ভাষার পাশাপাশি বাংলা ভাষারও ঠাঁই হলে বিভিন্ন মানুষের মধ্যে সহজে সম্পর্ক গড়ে ওঠার একটা সুযোগ থাকে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই শহরের সেই সৌভাগ্য আর হচ্ছে কই!’
তবে স্রোতের উলটোদিকে কিন্তু বরাবরই কিছু বয়ে যায়। এই যেমন অভিষেক আগরওয়াল। সেবক রোডে তাঁর কম্পিউটার বিক্রির দোকান। সাইনবোর্ড কিন্তু বাংলায় লেখা। কী কারণে এমনটা বলে প্রশ্ন করায় উত্তর এল, ‘বয়স্কদের অনেকে সাইনবোর্ডে বাংলায় লেখা দেখতে না পেলে সমস্যায় পড়েন। পাশাপাশি শহরের আবেগের বিষয়টি তো আছেই।’
এই শহরের এমন আরও অভিষেকের প্রয়োজন।