“বিসর্জন “
সৌমেন মুখোপাধ্যায়
রেল স্টেশনের প্লাটফর্মে রেল যাত্রীদের ভিড় লেগে গেছে, সবাই নিজের গন্তব্যস্থলে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে। প্লাটফর্মে একটা ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দুজনে ভাবতে থাকে এবার তারা কোথায় যাবে। এমনসময় পিছন থেকে এক চেনা নারীর কন্ঠস্বর ভেসে এসে তাদের সামনে থেমে যায়, “অনিলবাবু’। অনিল মাথা ঘুরাতেই দেখে মহিলাটি আর কেউ নয় তার অতি পরিচিতা চঞ্চলাদেবী।
“আচ্ছা লোক তো আপনি, ওখান থেকে ডাকছি আর আপনি কোন সাড়া দিচ্ছেন না।”
“আসলে আমি বুঝতে পারিনি তাই।” অনিল উত্তর দেয়।
চঞ্চলা শিউলীর দিকে তাকিয়ে বলে, “আপনি শিউলীদেবী না?”
“হাঁ,” অতি সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয় শিউলী।
“কি সৌভাগ্য, আপনাদের দুজনকে একসাথে আজ স্বচক্ষে দেখতে পাবো তা কল্পনাও করতে পারিনি । আপনি বিয়ে করলেন আর আমাকে জানালেন না। তা এখন যাবেন কোথায়?”
অনিল উত্তর দেয়, “না, আসলে হঠাৎ করে আমাদের বিয়েটা হয়ে গেল কারুকে জানাবার সুযোগ হয়নি। আর যাবার কথা বলছেন, দেখি কোথায় যাওয়া যাই।”
একটা ট্রেন স্টেশন ছাড়বে দেখে অনিল শিউলীর হাতটা ধরে বলে , “চলো এই সুযোগ পালিয়ে যায়।” আজ দুজনে বিনা টিকিটে ট্রেনযাত্রী, যদি টিটিতে ধরে তবে তারা শ্রীঘরে গিয়ে একটা আস্তানা পেয়ে যাবে। তাই তারা চঞ্চলাকে বলে, “আসছি। ট্রেন ছেড়ে দিল।”
আরও পড়ুন: Today’s Horoscope: আজ 21 December, আপনার ভাগ্যের চাকা কোন দিকে ঘুরছে
“আচ্ছা ঠিক আছে।” অপরপক্ষ থেকে উত্তর আসে।
ট্রেনে উঠে তারা কোনরকম করে সিট করে বসে পড়ে। কতগুলো পাঞ্জাবী লোক তাদের নিজেদের ভাষায় কথা বলছে আর মাঝে মাঝে তাদের দুজনকে দেখছে।
ট্রেনের জানালা দিয়ে ঠান্ডা বাতাস তাদের দুজনের গায়ে লাগতেই তারা ঘুমিয়ে পড়ে। একটা হালকা ধাক্কা খেতেই তাদের ঘুম ভেঙে যায়। চোখ মেলে দেখে টিটি টিকিট দেখতে এসেছে।
“টিকিট”,
অনিল বলে, “টিকিট কাটতে ভুলে গেছি।”
“তাহলে ফাইন সমেত টাকা দিন।”
“আমাদের কাছে কোন টাকাও নেই।”
এবার টিটি ধমক দেয়, বলে, “এটা কি মামাবাড়ি পেয়েছেন, বিনা টিকিটে আপনারা ট্রেনে উঠবেন। আমি পুলিশ ডাকতে বাধ্য হবো।”
“পুলিশ!” এবার দুজনে চমকে যায়।
কোথা থেকে এক ভদ্রলোক এসে টিটির হাতে কয়েকটা কাগজ ধরিয়ে বলে, “দেখুন ঠিক আছে ।”
“হাঁ”, এই বলে টিটি শেষবারের মতো অনিল আর শিউলীর দিকে তাকিয়ে অন্যদের টিকিট দেখতে থাকে।
ভদ্রলোকটির দিকে তাকিয়ে দেখে চমকে যায়, উনি আর কেউ নন তারই বাবার বন্ধু হরিশংকর মুখার্জী।
আরও পড়ুন: Indian Railwayas: ঠেলা সামলাতে জানুয়ারি থেকে বাড়তি বগি দিতে পারে রেল
“কাকাবাবু আপনি।”
“হাঁ অনিল। তোমাকে আমি এইভাবে দেখবো ভাবতে পারিনি। এখন যাবে কোথায়?”
অনিল মাথা নীচু করে চুপ হয়ে যায়। কোনরকমে মাথা তুলে কাকাবাবুকে জিজ্ঞেস করে, “বাড়ীর খবর কি কাকাবাবু? বাবা – মা কেমন আছে ?”
“বাড়ীর খবর!” এই বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাকাবাবু বলতে থাকে, “ভালো নয়। তোমার বাবা বেশকিছুদিন হলো পরলোক গমন করেছেন, তাই শোকে তোমার মা শয্যাশায়ী হয়েছেন। তোমার অনেক খোঁজ করা হয়েছে কিন্তু তোমার কোন হতিশ পাওয়া যায়নি।” আর একবার দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলে, “আমি বলি কি অনিল, এবার তোমরা বাড়ী ফিরে যাও। তোমার মায়ের এই শেষ অবস্থাতে তুমি তোমার মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়াও। তোমার মায়ের শেষ অবস্থায় তাকে আর কষ্ট দিও না।”
অনিলের চোখগুলো জলে ভরে যায়। কোনরকমে জামার কাপড়ে চোখের জল মুছে বলে, “বাবার কি হয়েছিল ?”
আরও পড়ুন:
“হার্ট অ্যাটাক।”
“উনি যাবার সময় তোমাকে ত্যাজ্য পুত্র করেননি, বরং উইল করে তোমাকে সমস্ত সম্পত্তি দিয়ে গেছেন। তাই বলছি তুমি বাড়ী যাও।”
অনিল এবার ছোট শিশুর মতো কাঁদতে থাকে।
“যাও অনিল, এখন আর রাগ-অভিমান করে তুমি তোমার মাকে দূরে সরিয়ে রাখো না, মায়ের সেবা করে মায়ের মুখে হাসি ফুটালে উনি সত্যি খুশি হবেন।”
“ঠিক আছে কাকাবাবু।”
ট্রেন স্টেশনে এসে থেমে যায়। ট্রেন যাত্রীরা সব একে একে নামতে থাকে আবার কেউ উঠতে থাকে।
ট্রেন থেকে অনিল আর শিউলী নেমে পড়ে। ট্রেন এবার তার গতি নিয়ে স্টেশন ছেড়ে চলে যায়।