অবশেষে থেমে গেল এক জীবন। অনেকদিন ধরেই বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার সঙ্গে লড়ছিলেন। বাড়িতে পড়ে গিয়ে হাত ভেঙে যাওয়ার পর থেকে শারীরিক পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপের দিকে যেতে থাকে। ভর্তি ছিলেন সল্টলেকের একটি বেসরকারি হাসপাতালে। ভেন্টিলেশন সাপোর্টে দিন কেটেছে, শরীরে রক্তে সংক্রমণ ধরা পড়ে মারাত্মকভাবে। একের পর এক জটিলতা কাটিয়ে ওঠার লড়াই চলছিল, কিন্তু শেষরক্ষা আর হল না। আজ দুপুর ২:২৮ নাগাদ প্রয়াত প্রাবন্ধিক, বক্তা, এবং বামপন্থী চিন্তক আজিজুল হক।
নকশালবাড়ি আন্দোলনের অন্যতম মুখ ছিলেন আজিজুল হক, ভারতের সেই সময়ের বামপন্থী রাজনৈতিক মানচিত্রের এক উল্লেখযোগ্য নাম। চারু মজুমদারের মৃত্যুর পর সিপিআই (এম-এল)-এর দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন তিনি। তাঁর লেখা “কারাগারে ১৮ বছর” বইটি নকশাল আন্দোলন ও সাতের দশকের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল।
আরও পড়ুনঃ তালিকায় নাম ছিল না পরেশ পালের, ভিতরে ঢুকতেই পারলেন না বিধায়ক পরেশ পাল; বললেন ‘মাথা ঘুরছে’
আজিজুল হকের জীবনের একটি বড় অংশ কেটেছে জেলে। নানা অভিযোগে, যার মধ্যে বিতর্কিত হত্যাকাণ্ডও রয়েছে, তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়। ১৯৭৭ সালে মুক্তি পেলেও ১৯৮২ সালে আবার গ্রেফতার হন। ১৯৮৬ সালে জেলের মধ্যে তাঁর উপর হওয়া শারীরিক নির্যাতন এবং রাজ্য কারাগারগুলোর করুণ পরিস্থিতি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পায়। তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতির পর বামফ্রন্ট সরকারের দুই মন্ত্রী—দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় ও যতীন চক্রবর্তী—জেলে গিয়ে দেখা করে বলেন, তাঁর প্যারোলে মুক্তি পাওয়া উচিত। শোনা যায়, কংগ্রেস নেতা সুব্রত মুখার্জিও তাঁর শরীরে অত্যাচারের চিহ্ন দেখেছিলেন।
সরাসরি রাজনীতি থেকে অনেকদিন আগেই সরে এসেছিলেন তিনি। কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘ভাষা শহীদ স্মারক সমিতি’। লিখে চলেছিলেন ‘সংবাদ প্রতিদিন’ এবং ‘আজকাল’-এ। জেলের মধ্যেই রচনা করেছিলেন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ “কারাগারে ১৮ বছর”, যা পুলিশের মহাফেজখানায় যাবার আগেই সাংবাদিক অশোক দাশগুপ্ত এবং ‘আজকাল’-এর এক তৎপর রিপোর্টারের উদ্যোগে জেল থেকে বাইরে এনে প্রকাশিত হয়।
সেই বইয়ে উঠে এসেছে শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের নির্মম চিত্র—সকালে লাঠির আঘাতে ঘুম ভাঙা, দুপুরে পচা খাবার, রাতে অবিরাম মানসিক নির্যাতন। সহবন্দী কমরেডদের হত্যা দেখতে দেখতেই তিনি লিখে গেছেন ইতিহাসের এক জ্বলন্ত অধ্যায়। এই বই তাঁর পক্ষ থেকে একটি দলিল হয়ে দাঁড়িয়েছে—রাজনৈতিক বন্দিদের উপর চালানো নিষ্ঠুরতার এক নিঃশব্দ সাক্ষী।
আরও পড়ুনঃ ‘খুব সুন্দর রাস্তা মেইনটেন হয়েছে’, পুলিশের ঢালাও প্রশংসা বিচারপতি ঘোষের
আজিজুল হকের প্রস্থান একটি যুগের অবসান। তিনি শুধু একজন প্রাবন্ধিক বা রাজনৈতিক কর্মী নন, ছিলেন এক ঐতিহাসিক সময়ের জীবন্ত দলিল। নকশাল আন্দোলন থেকে শুরু করে জেল জীবনের অভিজ্ঞতা—সবকিছুই তাঁর চিন্তা ও লেখায় প্রতিফলিত হয়েছে। প্রতিবাদ, সহ্যশক্তি এবং আদর্শের প্রতি অটল বিশ্বাসই তাঁকে আলাদা করে তুলেছিল। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কলম চালিয়ে গেছেন, লড়াই চালিয়ে গেছেন। তাঁর মৃত্যু শুধুমাত্র একটি ব্যক্তির অন্তর্ধান নয়, এক সংগ্রামী চেতনার অবসান। তবু তাঁর লেখা, তাঁর আদর্শ, আর স্মৃতি বেঁচে থাকবে আগামী প্রজন্মের জন্য।