কুশল দাশগুপ্ত, শিলিগুড়িঃ
ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথি। হিন্দু বৈষ্ণব আচারানুষ্ঠান অনুযায়ী এ দিনই শ্রীমতী রাধারানির আবির্ভাব তিথি—যা রাধাষ্টমী নামে সর্বত্র পরিচিত। এ বছর ৩১শে অগস্ট, রবিবার, সারাদেশে যেমন ভক্তির আবহ ছড়িয়ে পড়েছে, তেমনি বিশেষভাবে উৎসবমুখর নবদ্বীপের প্রাচীন মায়াপুরের শ্রীশ্রী রাধা মদন গোপাল মন্দির। তার আগে অর্থাৎ আজ শনিবার পালিত হচ্ছে ললিতা সপ্তমী।
শ্রীরাধিকার প্রিয় সখী শ্রীললিতা দেবীর আবির্ভাবতিথি উপলক্ষ্যে এ দিন সকাল থেকে মন্দিরে ভক্তরা সমবেত হতে শুরু করেছেন। ধর্মীয় আচার, ভজন-কীর্তন, ভাগবত পাঠ ও প্রসাদ বিতরণের মধ্য দিয়ে দিনভর চলবে অনুষ্ঠান। বেলা ১২টার পর অনুষ্ঠিত হবে ললিতা দেবীর পঞ্চামৃত অভিষেক, যেখানে বৈষ্ণব, গোস্বামী ও আচার্যগণ উপস্থিত হবেন। বিকালে অনুষ্ঠিত ভাগবত পাঠে প্রভুপাদ শ্রীকৃষ্ণ গোপাল গোস্বামীর কণ্ঠে শোনা যাবে ভক্তিমূলক বাণী। সন্ধ্যা নাগাদ কীর্তনের মাধ্যমে ললিতা সপ্তমীর পূজো সমাপ্ত হবে।
আরও পড়ুনঃ মা শ্বেতকালীর দর্শন, এবারের পুজোতে একদিনের গন্তব্য
রবিবার রাধাষ্টমী উপলক্ষে সকাল থেকেই শুরু হবে মহোৎসব। সকাল সাড়ে ৯টায় রাধারানি ঠাকুরানির মহাঅভিষেক অনুষ্ঠিত হবে সওয়া মণ দুধ, দই, মধু, ঘৃত এবং পঞ্চামৃত দিয়ে। অভিষেক চলাকালীন মন্দির প্রাঙ্গণে পরিবেশিত হবে জন্মলীলা কীর্তন। সকাল ১০টার পর শ্রীমতী রাধারানিকে নিবেদন করা হবে ৫৬ ভোগ। ভোগ আরতির পর মহাপ্রসাদের আয়োজন থাকবে ভক্ত ও স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য।বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে সন্ধ্যায় পরিবেশিত হবে ধবলিবেশে ‘রাধারানির মিলন কীর্তন’। কীর্তন শিল্পী রেণুকা পাল তার সুমধুর কণ্ঠে পরিবেশন করবেন ভক্তিসঙ্গীত। উৎসবকে কেন্দ্র করে রাধা মদন গোপাল মন্দির সাজানো হয়েছে ফুল-মালা, নানা রঙের বেলুন এবং আলোকসজ্জায়। রাধাষ্টমীর সকালে রাধারানি ও অন্যান্য বিগ্রহকে পরানো হবে নতুন পোশাক ও স্বর্ণালঙ্কার।
অদ্বৈত প্রভুর ত্রয়োদশ বংশধর শ্রী নিকুঞ্জ গোপাল গোস্বামীর সেবক, প্রভুপাদ কৃষ্ণ গোপাল গোস্বামী বলেন—”গৌর আনা প্রভু শ্রীঅদ্বৈত আচার্যের প্রাণবল্লভ রাধা মদন গোপাল। রাধারানি ছাড়া বৈষ্ণব সাধনা পূর্ণ হতে পারে না। তিনিই হচ্ছেন মহাশক্তি। তাঁর কৃপা ছাড়া গোবিন্দকে পাওয়া যায় না।”
মন্দিরের গৃহবধূ তিয়াশা গোস্বামী জানান—”রাধারানি হচ্ছেন মহাশক্তি। তাঁর জন্যই ৫৬ ভোগ নিবেদন করা হবে। ভোগ আরতির পর সেই মহাপ্রসাদ ভক্তদের মধ্যে বিতরণ করা হবে। প্রতি বছর যেমন, এ বছরও রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত ও বাইরের রাজ্য থেকেও ভক্তরা নবদ্বীপে উপস্থিত হচ্ছেন এই উৎসবে যোগ দিতে।”শাস্ত্র মতে, রাধাষ্টমীর দিনে ভক্তরা রাধারানির শ্রীচরণ দর্শনের সুযোগ পান। সাধারণত বছরের অন্য দিনে তাঁর চরণ ঢাকা থাকে, কিন্তু এই দিন ভক্তদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এ কারণে ভক্তরা বিশেষভাবে এ দিনটির জন্য অপেক্ষা করেন।
আরও পড়ুনঃ শুক্লা সপ্তমীতে ত্রিপুষ্কর যোগে বিশাখা নক্ষত্র, ব্যবসায় বাজিমাত করবে এই চার রাশি
রাধাষ্টমীর তাৎপর্য
হিন্দু ধর্মবিশ্বাসে শ্রীরাধা কেবল শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গিনী নন, তিনি প্রেম ও ভক্তির চূড়ান্ত প্রতীক। বৈষ্ণব দর্শন বলে—রাধা ছাড়া কৃষ্ণ অসম্পূর্ণ, আর কৃষ্ণ ছাড়া রাধাও পূর্ণ নন। ভক্তরা বিশ্বাস করেন, রাধার মধ্যে যে প্রেম ও আত্মনিবেদন কৃষ্ণের জন্য, সেটিই ভক্তির চরম রূপ। চৈতন্যদেবও রাধার ভক্তিকে সর্বোচ্চ ভক্তির প্রতীক বা মহাভাব হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন।
পুরাণ অনুসারে, রাধার জন্মকাহিনী নানা রূপে বর্ণিত। পদ্মপুরাণে তাঁকে বৃন্দাবনের বর্ষানার বৃষভানু ও কীর্তিদার কন্যা হিসেবে বলা হয়েছে। আবার ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে তাঁকে আদ্যাশক্তির অবতার বলা হয়েছে। এক মতে, জন্মের সময় তিনি পদ্মফুলের উপর আবির্ভূত হয়েছিলেন। এই সকল কাহিনী ভক্তমনে রাধার ঐশ্বর্য ও মহিমাকে আরও উজ্জ্বল করে তোলে।
রাধাষ্টমীর দিন বহু ভক্ত উপবাস পালন করেন। কেউ নির্জলা উপবাস, আবার কেউ ফলাহার করেন। ভোরবেলা স্নান-সাধন সেরে রাধাকৃষ্ণের মন্দিরে গিয়ে পূজা দেন। মূর্তির অভিষেক হয় দুধ, দই, মধু, ঘৃত, গঙ্গাজল দিয়ে। ফুল, তুলসী, ধূপ, দীপ, নৈবেদ্য নিবেদনের সঙ্গে সঙ্গে গাওয়া হয় রাধাষ্টক স্তোত্র, গীতগোবিন্দ ও ভক্তিগীত। রাধার জন্মস্থান বৃন্দাবনের বারসানা শহরে এই উৎসবের মাহাত্ম্য সর্বাধিক। হাজার হাজার ভক্ত সেখানে পদযাত্রা করে রাধারানির মন্দিরে যান। নবদ্বীপ-মায়াপুর, নদীয়া, বীরভূম, বর্ধমান ও কলকাতার বৈষ্ণব মন্দিরগুলোতেও বিশেষ আয়োজন হয়। ইস্কন মন্দিরে রাধা-মাধবের জন্য মহাসজ্জা, বিশেষ ভোগ ও সারাদিনব্যাপী সঙ্কীর্তনের ব্যবস্থা থাকে।
রাধা-কৃষ্ণের প্রেম কেবল রোমান্টিকতা নয়, এটি জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিলনের প্রতীক। ভক্তরা বিশ্বাস করেন, রাধার প্রেম ও আত্মনিবেদনই কৃষ্ণভক্তির প্রকৃত পথপ্রদর্শক। কবি চণ্ডীদাস লিখেছিলেন—”শুনহ রাধার একবার নাম, তাহার সম নয় কেহ ধাম।” অর্থাৎ, রাধার নাম উচ্চারণ করলেই ভক্ত হৃদয়ে প্রেম ও ভক্তির সঞ্চার হয়। রাধাষ্টমী তাই কেবল একটি উৎসব নয়, এটি ভক্তি, প্রেম ও আত্মনিবেদনের উৎসব। বৃন্দাবন থেকে বাংলার প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত, সর্বত্র ভক্তরা এ দিন রাধার নাম উচ্চারণ করে ভক্তিমূলক আবহ তৈরি করেন। ২০২৫ সালের এই রাধাষ্টমীও নবদ্বীপে হাজার হাজার ভক্তের উপস্থিতিতে মহোৎসবের আকার নিয়েছে। মন্দির প্রাঙ্গণে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে একটাই নাম—“রাধে রাধে”।