আলোচনা চলছিল, চ্যাম্পিয়ন হলে ভারতীয় দল ট্রফি নেবে কি না। তার অন্যতম কারণ মহসিন নকভি। পাকিস্তানের মন্ত্রী তিনি। পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের প্রধানও। সেই মহসিন নকভি আবার এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলেরও প্রধান। ফলে চ্যাম্পিয়নের হাতে ট্রফি তুলে দিতে মঞ্চে উপস্থিতও ছিলেন। কিন্তু ভারতীয় দল ট্রফিই নিল না তাঁর হাত থেকে।
সুপার ফোরের ম্যাচে পাকিস্তান পেসার হ্যারিস রউফ ফাইটার প্লেনের ইঙ্গিতে বিতর্ক উস্কে দিয়েছিলেন। পহেলগাঁও সন্ত্রাসবাদী হামলার ইঙ্গিত ছিল তাঁর অভিব্যক্তিতে। পিসিবি প্রধান নিজে রোনাল্ডোর এমন একটি সেলিব্রেশনের ছবি পোস্ট করেছিলেন। এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের প্রধান হওয়া সত্ত্বেও তাঁর আচরণ নানা প্রশ্ন তোলে।
সূর্যকুমার যাদব হাত না মেলানোর কারণ জানিয়েছিলেন। এর মধ্যে রাজনৈতিক বক্তব্য় রয়েছে, এই দাবিতে সূর্যকুমার যাদবের শাস্তি চেয়ে আইসিসির দরবারে গিয়েছিলেন পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান। তাঁর হাত থেকে ট্রফি না নিয়ে যোগ্য জবাব দিল ভারতীয় ক্রিকেট দল। পুরস্কার বিতরণে সঞ্চালক সাইমন ডুল বলেন, ‘আমাকে এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের তরফে জানানো হয়েছে, ভারতীয় দল আজ রাতে পুরস্কার নেবে না।’ ভারতীয় দলের ক্রিকেটাররা ট্রফি ছাড়াই সেলিব্রেট করেন।
আরও পড়ুনঃ এবার কী করবে পাকিস্তান? এবার কি পাকিস্তানের দিকে নজর ইজরায়েলের!
পাকিস্তানকে হারিয়ে এশিয়া কাপ জিতেও ট্রফি পেল না ভারতীয় দল। অভিযোগ, ট্রফি এবং ভারতীয় ক্রিকেটারদের মেডেল নিয়ে নিজের হোটেলের ঘরে চলে গিয়েছেন পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড তথা এশীয় ক্রিকেট কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মহসিন নকভি। এই ঘটনায় হতবাক ভরতীয় ক্রিকেট দল। ভারত অধিনায়ক সূর্যকুমার যাদব জানালেন, এমন ঘটনা তিনি জীবনে দেখেননি।
এশিয়া কাপ জিতে ট্রফি ছাড়াই উল্লাস করেছেন ভারতীয় ক্রিকেটার ও সাপোর্ট স্টাফেরা। ২০২৪ সালে টি২০ বিশ্বকাপ জিতে রোহিত শর্মা যে কায়দায় ট্রফি তুলেছিলেন, সেই একই কায়দায় উল্লাস করলেন সূর্যেরা। পার্থক্য একটাই। সেবার রোবিতের হাতে ট্রফি ছিল। এবার কল্পনায় ট্রফি তুললেন সূর্য। পরে সাংবাদিক বৈঠকে এসে সেই বিষয়ে মুখ খুললেন সূর্য। তিনি বললেন, “চ্যাম্পিয়ন দল ট্রফি পাচ্ছে না, ক্রিকেট খেলা শুরু করার পর থেকে জীবনে এমন ঘটনা আমি দেখিনি। তবে আমার মতে দলের ক্রিকেটার ও সাপোর্ট স্টাফেরাই আসল ট্রফি। সকলে বলছেন, ভারত এশিয়া কাপের চ্যাম্পিয়ন। এটাই আসল কথা।”
গ্রুপ পর্বে পাকিস্তানকে হারিয়ে ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর জন্য ভারতীয় সেনাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন সূর্য। চ্যাম্পিয়ন হয়ে এশিয়া কাপে নিজের ম্যাচ ফি-র পুরোটাই ভারতীয় সেনাকে দান করতে চলেছেন ভারত অধিনায়ক। উল্লেখ্য, এশিয়া কাপ ফাইনালে ভারতের জয় টেলিভিশনে দেখেছেন সেনা বাহিনীর জওয়ানেরা। ভারত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর তাঁদের উল্লাসের ছবিও দেখা গিয়েছে সমাজমাধ্যমে।
ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের অভিযোগ, সূর্যকুমারেরা ট্রফি নিতে অস্বীকার করায় এশিয়া কাপের ট্রফি ও ভারতীয় ক্রিকেটারদের মেডেল নিয়ে পালিয়ে গিয়েছেন নকভি। সংবাদ সংস্থা এএনআই-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সচিব দেবজিৎ শইকীয়া বলেন, “যেহেতু ভরত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের পরিস্থিতি রয়েছে তাই আমরা এমন কারও কাছ থেকে পুরস্কার নেব না, যিনি পাকিস্তানের মন্ত্রী। নীতিগত ভাবে এই সিদ্ধান্ত আমরা আগেই নিয়েছিলাম। তার মানে এই নয় যে ভদ্রলোক ট্রফি ও মেডেল নিয়ে পালিয়ে যাবেন। এই ঘটনা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। আশা করছি ভদ্রলোক দ্রুত ট্রফি ও মেডেল ভারতে ফেরত দিয়ে দেবেন।”
এখানেই থেমে থাকছে না ভারত। নকভির এই কাজের বিরুদ্ধে বিশ্ব ক্রিকেটর নিয়ামক সংস্থার কাছে অভিযোগ জানাবে তারা। শইকীয়া বলেন, “নভেম্বর মাসে দুবাইয়ে আইসিসি-র বৈঠক আছে। সেখানে আমরা এশীয় ক্রিকেট কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে জোরাল প্রতিবাদ জানাবো।”
এশিয়া কাপ ফাইনাল শেষ হওয়ার পরেই শুরু হয়েছিল নাটক। ফাইনাল শেষ হওয়ার পর সকলের নজর ছিল, কার হাত থেকে ট্রফি নেন সূর্যেরা। খেলা শেষ হলেও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান শুরু হচ্ছিল না। ভারতীয় ক্রিকেটারেরা মাঠেই দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানের ক্রিকেটারদের দেখা পাওয়া যাচ্ছিল না। শোনা গিয়েছে, ভারত নাকি জানিয়ে দেয়, তারা নকভির কাছ থেকে ট্রফি নেবে না। গ্রুপ পর্বের ম্যাচে পাকিস্তানকে হারিয়ে এই একই কথা বলেছিলেন অধিনায়ক সূর্য। কিন্তু মাঠে ছিলেন নকভি। কারও সঙ্গে ফোনে কথা বলতে দেখা যায় তাঁকে। নকভিকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল, বেশ রেগে রয়েছেন তিনি। খেলা শেষ হওয়ার ১ ঘণ্টা পর সাজঘর থেকে বেরিয়ে আসেন পাক ক্রিকেটারেরা। সওয়া ১ ঘণ্টা পর শুরু হয় পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান।
প্রথমে ব্যক্তিগত পুরস্কার দেওয়া হচ্ছিল। তার পর পাকিস্তানের ক্রিকেটারদের মেডেল নিতে ডাকা হয়। সেখানেও নাটক। সঞ্চালক সাইমন ডুল জানান, পাক ক্রিকেটারদের মেডেল দেবেন নকভি। কিন্তু আদতে দেখা যায়, এশীয় ক্রিকেট কাউন্সিলের অন্য এক কর্তা আমিরুল ইসলাম তাঁদের মেডেল দিচ্ছেন। এশিয়া কাপে রানার আপ হওয়ায় ১ কোটি ৭০ লক্ষ টাকার চেক পেয়েছে পাকিস্তান। অধিনায়ক সলমন আলি আঘা সেই চেক ছুড়ে ফেলে দেন।
ভারতের কুলদীপ যাদব ম্যাচের সেরা ও অভিষেক শর্মা প্রতিযোগিতার সেরা ক্রিকেটারের পুরস্কার পান। তাঁরা পুরস্কার নেওয়ার পর সঞ্চালক ডুল জানান, ভারতীয় দল চ্যাম্পিয়নের ট্রফি নেবে না। এর থেকে স্পষ্ট, নকভিও নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরেননি। অন্য কোনও কর্তাকে তিনি ট্রফি দেওয়ার অনুমতি দেননি। সেই কারণে ভারতীয় দলও নিজেদের দাবি থেকে সরেনি। এই দৃশ্য ক্রিকেটের ইতিহাসে কোনও দিন দেখা যায়নি। একটা বড় প্রতিযোগিতা জিতে জয়ী দল ট্রফিই নিল না। বোঝা যাচ্ছে, এই বিতর্ক এখনই থামবে না। এশিয়া কাপ শেষ হয়ে গেলেও ভারত-পাকিস্তান সংঘাত এখনও চলবে।
এ বারের এশিয়া কাপের শুরু থেকেই দু’দলের মধ্যে সংঘাত চলছে। শুরুটা করে ভারত। গ্রুপ পর্বের ম্যাচে পাকিস্তানের ক্রিকেটারদের সঙ্গে হাত না মেলানোর সিদ্ধান্ত নেয় তারা। সেই ঘটনা ভাল ভাবে নেয়নি পাকিস্তান। খেলা শেষে সূর্য প্রকাশ্যে বলেন, এই জয় পহেলগাঁওয়ে জঙ্গি হামলায় নিহতদের পরিবারকে উৎসর্গ করছেন তাঁরা। পাশাপাশি ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রশংসা করেন তিনি। খেলা শেষে নিজেদের সাজঘরের দরজাও বন্ধ করে দেয় ভারত। সেই ঘটনা নিয়ে আইসিসি-র দ্বারস্থ হয় পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড। সূর্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে তারা। সূর্যের ম্যাচ ফি-র ৩০ শতাংশ জরিমানা করা হয়েছে। সেই ঘটনার বিরুদ্ধে আবেদন করেছে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড।
আরও পড়ুনঃ ব্যতিক্রমী উদ্যোগ! মমতা-অমিত শাহ নন, পুজোর উদ্বোধন হল রিক্সা-চালকের হাতে
বিতর্কে জড়িয়েছেন সেই ম্যাচের রেফারি অ্যান্ডি পাইক্রফ্টও। পাক বোর্ড অভিযোগ করে, পাইক্রফ্ট গিয়ে দুই দলের অধিনায়ককে হাত মেলাতে নিষেধ করেছেন। তারা দাবি জানায়, এশিয়া কাপের কোনও ম্যাচে পাইক্রফ্টকে আর দায়িত্ব দেওয়া যাবে না। যদিও পাকিস্তানের দাবি উড়িয়ে দেয় আইসিসি। পরের পাক ম্যাচের আগে পাইক্রফ্টের সঙ্গে কথা বলেন পাকিস্তানের কোচ মাইক হেসন, অধিনায়ক সলমন ও অন্য কর্তারা। পরে পাক বোর্ড দাবি করেন, পাইক্রফ্ট ক্ষমা চেয়েছেন। যদিও অন্য সূত্রে দাবি করা হয়, তিনি ক্ষমা চাননি।
সুপার ফোরে ভারত-পাক ম্যাচে বিতর্ক আরও বাড়ে। অর্ধশতরান করে ‘স্টেনগান’ উল্লাস করেন পাকিস্তানের ব্যাটার সাহিবজ়াদা ফারহান। পাক পেসার হ্যারিস রউফ দু’বার ‘প্লেন ক্র্যাশ’ সেলিব্রেশন করেন। সেই ঘটনার পর ফারহান ও হ্যারিসের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে ভারতীয় বোর্ড। ফাইনালেও যে বিতর্ক কমবে না তা বোঝা যাচ্ছিল। ফাইনাল শুরু হওয়ার আগেই ভারতের পেসার অর্শদীপ সিংহের নামে অভিযোগ করে পাক বোর্ড। তাদের অভিযোগ, সুপার ফোরের ম্যাচে ‘অশ্লীল’ ভঙ্গী দেখিয়েছেন অর্শদীপ।
ফাইনাল শুরুর আগে ভারতের জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার সময় খোশগল্প করছিলেন পাকিস্তানের দুই ক্রিকেটার হ্যারিস ও শাহিন শাহ আফ্রিদি। ক্রিকেটের নিয়মে রয়েছে, অন্য দেশের জাতীয় সঙ্গীতের সময়ও সাবধান ভঙ্গীতে থাকতে হবে ক্রিকেটারদের। গল্প করা যাবে না। কিন্তু পাকিস্তানের দুই ক্রিকেটার সেটাই করেন। তার জন্য দু’জনের সমালোচনা শুরু হয়েছে। ভারতীয় সমর্থকদের অভিযোগ, ভারতের জাতীয় সঙ্গীতকে অসম্মান করেছেন তাঁরা। হ্যারিস ও শাহিনের শাস্তির দাবিও উঠেছে। ফাইনালে হ্যারিসকে বোল্ড করে তাঁকে জবাব দেন জসপ্রীত বুমরাহ। তিনিও ‘প্লেন ক্র্যাশ’ উল্লাস করেন।
খেলার মধ্যেই যে এই বিতর্ক শেষ হবে না তা বোঝা যাচ্ছিল। হলও তাই। খেলা শেষে পাকিস্তানের ক্রিকেটারেরা সাজঘরে ঢুকে গেলেন। পর পর তিন ম্যাচে ভারতের কাছে হারের ধাক্কা হজম করা সহজ ছিল না। পাশাপাশি গোটা প্রতিযোগিতা জুড়ে ভারত বয়কট করেছে পাকিস্তানকে। সেই জ্বালাও হয়তো ছিল। পাক ক্রিকেটারদের মাঠে নামতে দেরি হওয়া দেখে জল্পনা শুরু হয়েছে, সলমনেরা কি অনুষ্ঠান বয়কটের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন? শেষ পর্যন্ত কি নকভির ফোনে নামেন তাঁরা? নইলে এত দেরি কেন করলেন তাঁরা। যদিও ভারতীয় ক্রিকেটারেরা আরও এক বার পাত্তা দিলেন না নকভিকে। এশিয়া কাপ জিতে ট্রফিই নিলেন না সূর্যেরা।