দেবজিৎ মুখার্জি, কোলকাতাঃ
পাটকাঠির আলো দে/ লক্ষ্মীর পো বিয়ে দে/ একগোলা ধান, একটা এঁড়ে বাছুর নিয়ে/ এই আলো ভর করে আমাদের বাড়ি এসো। লক্ষ্মীর বোন সরস্বতীকে সকলেই চেনেন। কিন্তু, লক্ষ্মীর আরও এক দিদি আছে, যাঁকে অনেকেই চেনেন না। তাঁর নাম অলক্ষ্মী। কালীপুজোর সন্ধ্যায় বাংলার একাংশের মধ্যে আজও এই অলক্ষ্মী বিদায় করে লক্ষ্মীপুজো কিংবা ভিন্নমতে দীপান্বিতা লক্ষ্মীপুজো করা হয়।
আসলে কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর সময় যখন দেবী লক্ষ্মী আসেন, সেই সময় তাঁর সঙ্গে আসেন অলক্ষ্মীও। কালী পুজোর দিন অশুভ নাশ করে শুভশক্তির আগমন করার সঙ্গেই এই অলক্ষ্মীকেও পুজো করে বিদায় জানানো হয়।
দীপান্বিতা লক্ষ্মীপুজো মূলত পশ্চিম ও মধ্যবঙ্গের রীতি, বরেন্দ্র অঞ্চলের কিছু প্রাচীন পরিবারেও এটি পালিত হত। শহরাঞ্চলে বিশেষ করে কলকাতা সংলগ্ন এলাকায় ‘বাঙাল’রা চলে আসায়, কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। পূর্ববঙ্গীয়দের এই রীতি নেই, এদেশীয় বা ঘটিদের বাড়িতেই এই পুজোর চল বেশি করে দেখা যায়। তাই দক্ষিণবঙ্গের জেলায় জেলায় এখনও দীপান্বিতা লক্ষ্মীপুজো খুব ভালোভাবেই পালিত হয়। দেশের সর্বত্রই দীপাবলির সন্ধ্যায় লক্ষ্মী আরাধনা সবচেয়ে বেশি প্রচলিত, তাই দীপান্বিতা লক্ষ্মীপুজো প্রকৃতপক্ষে সর্বভারতীয় সংস্কৃতিরই অন্তর্গত।
আরও পড়ুনঃ করালবদনা কালী যেন পাশের বাড়ির শ্যামলা মেয়েটি! আদর করে ‘মা’ বলে ডাকে বাঙালি
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলার ব্রতকথায় লিখেছিলেন, ‘মেয়েরা বছরে আরও কয়েকবার লক্ষ্মীব্রত করেন, যেমন ভাদ্রে, কার্তিকে, চৈত্রে। কিন্তু সেগুলো ঐ তিন লক্ষ্মীব্রতরই ছাঁচে চালা।’ তিন লক্ষ্মীব্রত বলতে হরিতা দেবী, কোজাগরী লক্ষ্মী ও অঘ্রাণ মাসে অরুণা লক্ষ্মীর কথা লিখেছেন তিনি। কার্তিক মাসে যে লক্ষ্মীর আরাধনার কথা অবনীন্দ্রনাথ লিখেছেন তা দীপান্বিতা লক্ষ্মী। ঘর থেকে অলক্ষ্মী দূর করতে এই পুজো হয়। দীপান্বিতা শব্দের অর্থ দীপের আলো। আলোর রোশনাইয়ে সেজে ওঠার দিনে দীপান্বিতা লক্ষ্মীর পুজো হয়।
দীপান্বিতার দিন লক্ষ্মী একাই পূজিত হন না। কলার ডোঙার উপরে চালের পিটুলিতে লক্ষ্মী, নারায়ণ ও কুবেরের মূর্তি বানানো হয়। কলার ডোঙা সমেত এঁদের তিনজনকে রাখা হয় ধানের আঁড়ির সামনেই। সেখানেই তিন দেবতার পুজো হয়। অমাবস্যার পরদিন অর্থাৎ শুক্ল প্রতিপদে হয় কুবেরের বিয়ে। কোনও জলা বা তিন রাস্তার মাথায় পাটকাঠির মশাল জ্বালিয়ে ফেলে আসা হয় অলক্ষ্মীকে। ঘর থেকে বিদেয় করে।
পুরাণ মতে, এই অলক্ষ্মী আসলে কিন্তু লক্ষ্মীর দিদি। লক্ষ্মীর ছায়া এবং দুর্ভাগ্যের দেবী তিনি। অলক্ষ্মী কল্কি পুরাণ ও মহাভারত অনুযায়ী, বিরাটাকায় দৈত্য কলির দ্বিতীয়া স্ত্রী। তাঁর বাহনও গাধা। পুরাণে তাঁর রূপ বর্ণনা হয়েছে, গোরু খেদানো, হরিণের মতো পা, ষাঁড়ের মতো দাঁত। আরেকটি মতে, দেহ শুষ্ক, গাল কুঞ্চিত, ওষ্ঠাধর স্ফীত, ক্ষুদ্র, গোলাকার ও উজ্জ্বল চক্ষুবিশিষ্ট। এঁদের জন্মবৃত্তান্ত নিয়েও নানা মুনির নানা মত প্রচলিত রয়েছে। কেউ বলেন, প্রজাপতি ব্রহ্মার মুখের আলো থেকে জন্ম নিয়েছেন লক্ষ্মী আর পিঠ থেকে জন্ম হয়েছে অলক্ষ্মীর। তবে সবচেয়ে প্রচলিত কাহিনিটি হল সমুদ্রমন্থনের। সমুদ্রমন্থনের সময় সমুদ্র থেকে উঠে আসা অমৃতের পাত্র নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন দেবী লক্ষ্মী। আর তার ঠিক আগেই নাকি জন্ম নেন অলক্ষ্মী। অলক্ষ্মী তাঁর ছোট বোনকে স্বামীর সঙ্গে বিষ্ণুলোকে বাস করতে দেখে ঈর্ষান্বিত হলে লক্ষ্মীই তাঁকে বর দেন। কলি হবে অলক্ষ্মীর স্বামী। অপরিচ্ছন্ন, কুৎসিত, আলস্য, অত্যাচার, ঈর্ষা, ক্রোধ, ভণ্ড, লোভ ও কামের মধ্যে তিনি বাস করবেন। যে পুরাণ মতই মানা হোক না কেন, সব দিকে এটাই বোঝায় যে, লক্ষ্মী ও অলক্ষ্মী হলেন দুই বোন। পুরাণ ও শাস্ত্রে দেবী অলক্ষ্মীকে বর্ণনা করা হয়েছে কুরূপা, ঈর্ষা ও দুর্ভাগ্যের প্রতীক হিসেবে। গাধার পিঠে চেপে তিনি হাজির হন ঘরে ঘরে…।
আরও পড়ুনঃ সাধ্য যোগে পুষ্য নক্ষত্র, ব্যবসায় বাজিমাত এই চার রাশির
তাহলে তাঁর আরাধনা কেন করা হয়? তাও কালীপুজোর দিনেই? অমঙ্গল ও অশুভের প্রতীক হলেও, অলক্ষ্মীকে ভগবতীর এক রূপ বলে মনে করা হয়। আমাদের সবার মধ্যেই সাদা এবং কালো— দুটি দিকই আছে। কখনও কখনও হিংসা, ঘৃণা, বিদ্বেষে ভরে উঠি আমরা। আমাদের ভেতরের ‘লক্ষ্মী’র সঙ্গে ঢুকে যায় অলক্ষ্মীও। মনে করা হয়, কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর সময় দেবী লক্ষ্মীর সঙ্গে হাজির হন অলক্ষ্মীও। তাই তাঁকে পুজো করেই বিদায় করা হয়। আর এমন কাজ করার জন্য কালীপুজোই হল আসল দিন। যখন অশুভের নাশ করতে শুভশক্তির উদয় হয়।
গোবর দিয়ে তৈরি করা হয় অলক্ষ্মীর মূর্তি। আর পিটুলি দিয়ে লক্ষ্মী-নারায়ণ এবং কুবেরের মূর্তি। পুজো হয়ে গেলে মেয়েরা অলক্ষ্মীর সেই মূর্তিটিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন রাস্তায়। সঙ্গে শোনা যায় সমবেত ধ্বনি, ‘লক্ষ্মী আয়, অলক্ষ্মী যা’। এইভাবেই ঘরের সব অশুভকে অলক্ষ্মীর বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গেই বাইরে রেখে আসেন তাঁরা। ভেতরে থেকে যান কেবল লক্ষ্মী।
এই কারণে কালীঘাটে কালীপুজোর সন্ধ্যায় সবার আগে পুজো করা হয় দেবী অলক্ষ্মীর। দীপান্বিতা অমাবস্যায় দক্ষিণাকালীই মহালক্ষ্মী রূপে পূজিতা হন। তবে কালীঘাটে মহালক্ষ্মী ও ধনলক্ষ্মী উভয়েরই আরাধনা করা হয়।