Tuesday, 14 October, 2025
14 October
HomeকলকাতাLaxmi Puja 2025: দিন বদলেছে, লক্ষ্মী মেয়ে আজ দস্যি; সময়ের সঙ্গে বদলে...

Laxmi Puja 2025: দিন বদলেছে, লক্ষ্মী মেয়ে আজ দস্যি; সময়ের সঙ্গে বদলে যাচ্ছে ‘লক্ষ্মীমন্ত’ মেয়ের ধারণা!

একুশ শতকেও ‘লক্ষ্মী’ মেয়ের ধারণা কি তা হলে একই রয়ে গিয়েছে? ‘লক্ষ্মীমন্ত’ শব্দের অর্থ কি একটুও বদলায়নি?

অনেক কম খরচে ভিডিও এডিটিং, ফটো এডিটিং, ব্যানার ডিজাইনিং, ওয়েবসাইট ডিজাইনিং এবং মার্কেটিং এর সমস্ত রকম সার্ভিস পান আমাদের থেকে। আমাদের (বঙ্গবার্তার) উদ্যোগ - BB Tech Support. যোগাযোগ - +91 9836137343.

বাড়িতে ফুটফুটে মেয়ের জন্ম হলেই বাড়ির গুরুজনেরা বলে ওঠেন, ‘‘লক্ষ্মী এসেছে ঘরে।’’ লক্ষ্মী সম্পদ আর সৌন্দর্যের দেবী। বৈদিক যুগে মহাশক্তি হিসেবে তাঁকে পুজো করা হত। তবে পরবর্তী কালে স্থিতির রক্ষক নারায়ণের সঙ্গে তাঁকে জুড়ে দেওয়া হয়। লক্ষ্মী দেবী থেকেই ‘লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে’র ভাবনা তৈরি হয়েছে। স্বামীর আস্থা অর্জন করে সংসার গুছিয়ে তোলার দায়িত্ব সেই কোন কাল থেকেই লক্ষ্মী মেয়ের উপর চাপিয়ে দিয়েছে সমাজ। একুশ শতকেও ‘লক্ষ্মী’ মেয়ের ধারণা কি তা হলে একই রয়ে গিয়েছে? ‘লক্ষ্মীমন্ত’ শব্দের অর্থ কি একটুও বদলায়নি?

লক্ষ্মীর আর এক নাম ‘চঞ্চলা’। তিনি এই আছেন, এই নেই। মানুষের সৌভাগ্যও তেমনই। আজ যে রাজা, কাল তার ফকির হতে কতক্ষণ! বাংলার ব্রতকথায় লক্ষ্মীদেবীকে এক গৃহ ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যেতেও দেখা যায়। কিন্তু ‘লক্ষ্মী’ অভিধাটির মধ্যে এই ‘চঞ্চলা’ ভাবটি যেন নেই। ব্রতে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্মীর অচলা রূপটিকেই যেন কামনা করা হয় এই সম্বোধন বা বিশেষণের দ্বারা। ‘‘লক্ষ্মীমন্ত হও। শান্ত হও। চলার সময়ে পায়ের শব্দটি যেন না হয়। গলার স্বর যেন খুব তীব্র না হয়।’’ এই সহবতের পাঠ বাংলা যুগে যুগে দিয়ে এসেছে তাদের মেয়েদের। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদের অস্তিত্বকে যেন ছায়ার মতো ধরা হয়। ‘চঞ্চলা’ লক্ষীকে কেউই কামনা করেন না।

আরও পড়ুনঃ ধনদেবীর আরাধনা; বাঁকুড়ায় লক্ষ্মী আসেন হাতির পিঠে!

অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত মতে, ‘‘লক্ষ্মী শব্দটির মধ্যে একটা ইতিবাচক দিক আছে। সেই দিকটায় আমি সমর্থন করি। তবে লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে মহিলাদের তুলনা করে তাঁদের গোড়ালির গড়ন, চুলের দৈর্ঘ্য, মুখশ্রী নিয়ে যে সব মন্তব্য করা হয়, আমি তার তীব্র বিরোধিতা করি। বাড়ির মহিলারাই যখন বাড়ির বৌ দেখতে যান, তাঁদের মুখে আজও শোনা যায় নানা প্রশ্ন। রান্না করতে পার তো? রোজ পুজোপাঠ করা হয় তো? ঘর গোছাতে ভালবাস তো? এই সব পরীক্ষায় পাশ করলেই সেই মেয়ে নাকি লক্ষ্মীমন্ত, আমি তা মানি না।’’

দাম্পত্য, সংসার, সন্তানের বাইরেও আজকের লক্ষ্মীরা নিজেদের প্রমাণ করছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। ঋতুপর্ণা বলেন, ‘‘সম্প্রতি আমি একটা ছবি করেছি ‘বেলা’। সেই ছবিতে বেলা কী ভাবে তার ঘরে লক্ষ্মী নিয়ে আসবে, সেটাই দেখানো হয়েছে। বেলা শুধু নিজেই রোজগার করছে এমন নয়, তার মতো আরও অনেক মহিলাকে রোজগার করার পথ দেখিয়েছে সে। আমার কাছে বেলাই আসল লক্ষ্মীমন্ত। লক্ষ্মীর ঝাঁপি তো সঞ্চয়ের প্রতীক! আজকের লক্ষ্মীরা যেমন উপার্জন করতে জানে, তেমনই সে সঞ্চয় করার পথও তো তাঁদের জানা আছে।’’

সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রায় ১০ বছর ধরে কাজ করছেন অনুপ্রভা দাস মজুমদার। তিনি একজন রূপান্তরিত নারী। অনুপ্রভার মতে, ‘‘দেবী লক্ষ্মী শ্রী এবং সৌন্দর্যের দেবী। ব্যক্তিভেদে নিজেকে বিকশিত করা, নিজের পরিচিতি তৈরি করা, ভিতর ও বাইরে সুন্দর হয়ে ওঠার সংজ্ঞা কিন্তু আলাদা। এই সৌন্দর্য কিন্তু জীবন্ত। ছাঁচে ঢালা প্রতিমার মতো একেবারেই নয়। প্রতিটি স্বতন্ত্র মানুষ তাঁর বৈশিষ্ট্য, নিজস্বতা, প্রতিভা নিয়ে পূর্ণ হয়ে ওঠেন। যুগ যুগ ধরে ‘লক্ষ্মীমন্ত’ বলতে চিরাচরিত যে ধারণা চলে এসেছে, সেটা তো ভীষণ অবাস্তব। এই ধারণা আগেও নারীরা বহু বার ভেঙেছে, এখনও নিজেদের মতো করে ভেঙে চলেছে। কেবল বাইরে থেকে নয়, ভিতর থেকেও লক্ষ্মীর মতো সুন্দর হয়ে উঠছেন তাঁরা। প্রত্যেকে প্রত্যেকের মতো সুন্দর। সেই সৌন্দর্য, সেই শ্রী-কে দেখতে পারা, বুঝতে পারার শিক্ষা যেন আমরা অর্জন করে উঠতে পারি এবং স্বকীয়তার আলোয় যেন আলোকিত হতে পারে আমাদের চারপাশ।’’

‘লক্ষ্মীমন্ত’-এর ধারণায় বিশ্বাসী নন, অভিনেতা ঋদ্ধি সেন। অভিনেতার মতে, ‘‘লক্ষ্মীমন্ত বলতে যে ছবিটা সামাজিক ভাবে তৈরি করা হয়েছে, আমার মনে হয় সেটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নিজেদের সুবিধার কথা ভেবেই খানিকটা তৈরি করেছে। আমার বাড়ির লোকজন সেই ধারণায় বিশ্বাসী না হলেও, আমি তো সেই সমাজেরই অংশ, তাই সেই ধারণা হয়তো কোথাও না কোথাও আমার চিন্তাধারাতেও লুকিয়ে আছে। অনেকেই বলবে, সমাজ, এখন বদলেছে। তবে আমার মনে হয় বদলটা খুবই উপর উপর দেখা যাচ্ছে। চারপাশে এমন অনেক মানুষই দেখি, যাঁরা মুখে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা বললেও মনে মনে কিন্তু এখনও বস্তাপচা ধারণাতেই বিশ্বাসী। মহিলাদের নিয়ে তাঁদের ভাবনা কোথাও গিয়ে খুবই সীমিত।’’

পাত্রপাত্রী বিজ্ঞাপন হোক কিংবা ধারাবাহিকে প্রধান নারীর চরিত্র বাছাইয়ের সময় এখনও কিন্তু সেই লক্ষ্মীমন্ত মেয়েটিরই খোঁজ পড়ে। সমাজের ভাবনায় বদল এলে কিন্তু এমনটা হওয়ার কথা নয়, মত ঋদ্ধির। অভিনেতা বললেন, ‘‘নতুন প্রজন্ম বিশেষ করে জেন জ়ি কিন্তু এই বিষয়ে অনেকখানি সরব। তারা কিন্তু নির্দ্বিধায় এই ধারণাগুলির প্রতিবাদ করে। মেয়েদের লক্ষ্মীমন্ত হতে হবে, এই ধারণা তারা মানে না। তাদের বাড়ির লোকজনের কাছে প্রতিবাদ জানায়, তবে সেই প্রতিবাদে লাভ কতখানি হচ্ছে বা হবে, সেটা ভাবার বিষয়।’’

সময়ের সঙ্গে বাংলায় যে ‘লক্ষ্মীমন্ত’ শব্দটিরও বিবর্তন ঘটেছে, তা বিশ্বাস করেন অভিনেত্রী নুসরত জাহান। নেপথ্যে রয়েছে নারীর শিক্ষা এবং স্বাধীনতা। নুসরত বললেন, ‘‘প্রথাগত ভাবে দেখতে গেলে, লক্ষ্মীমন্ত মানে একাধারে নমনীয় অথচ দৃঢ়চেতা নারীকে বোঝানো হয়।’’ নুসরতের মতে, সমকালীন সমাজে একজন নারী শুধুমাত্র ধৈর্য নয়, বরং তাঁর মধ্যে নিহিত শক্তির মাধ্যমেও লক্ষ্মীর প্রতীক হয়ে ওঠেন। নীরবতা এখন আর তাঁর ‘আত্মসমর্পণ’ নয়। নুসরতের কথায়, ‘‘নরম স্বভাবের এবং প্রয়োজনে মন শক্ত রাখা— এই দুটো দিকের ভারসাম্য বজায় রাখা এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।’’

পোশাকশিল্পী পরমা ঘোষ বললেন, ‘‘লক্ষ্মীদেবী তো চঞ্চল, তিনি অস্থির। তা হলে একজন শান্ত, চুপচাপ মেয়েকে কেনই বা লক্ষ্মীর সঙ্গে তুলনা করা হয়, সেটাই তো বুঝি না। আমি মনে করি লক্ষ্মীমন্ত সেই-ই, যার কাছে লক্ষ্মী আছে। তার থেকে বড় আর কিছুই হতে পারে না। এখন প্রতিটি মেয়ের আর্থিক স্বাধীনতা থাকাটা ভীষণ জরুরি। একজন মেয়েকে জানতে হবে, তার কাছে ঠিক কত টাকাপয়সা আছে, কত সঞ্চয় আছে, সেই টাকা কোথায় বিনিয়োগ করলে তার বেশি লাভ হবে, বুড়ো বয়সে গিয়ে তার হাতে কত পুঁজি থাকবে, তবেই হবে সে লক্ষ্মীমন্ত।’’ পরমার ইঙ্গিত লক্ষ্মী যে ধনদেবী, তার ব্যঞ্জনার দিকে।

আরও পড়ুনঃ ব্যাপক সংঘর্ষ, কটকে ৩৬ ঘণ্টার কার্ফু, বন্ধ ইন্টারনেট

সুরকার দেবজ্যোতি মিশ্রের ধারণায়, সেই মেয়েটিই ‘লক্ষ্মী’, যে তার নিজের যাপনকে বজায় রেখেও চারপাশ সম্পর্কে সচেতন। দেবজ্যোতির মতে, আজকের ‘লক্ষ্মী’ মেয়েটি থাকে মিছিলের পুরভাগে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে রাত দখলেও পিছপা নয়। আবার পাশাপাশি তাঁর মতে, ‘লক্ষ্মী’ সে-ও, যে লক্ষ্মীকান্তপুর থেকে ভোররাতের লোকাল ধরে শাকসব্জি বিক্রি করতে আসে মহানগরে। ‘‘সারা পৃথিবী জুড়ে যে মেয়েরা পথে নামছে, যারা দখল নিচ্ছে পূর্ণচাঁদের প্রতিবাদী বিশ্বকে, তারাই ‘লক্ষ্মী’,’’ বললেন দেবজ্যোতি।

কিন্তু ‘লক্ষী’ কি শুধু মেয়েরাই? বাংলা লব্জে তো ‘লক্ষ্মী ছেলে’-ও হয়! যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক, কবি এবং প্রাবন্ধিক অভীক মজুমদার জানালেন, তাঁদের বিভাগীয় পত্রিকায় অধ্যাপক মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় একটা নিয়ম চালু করেছিলেন। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে নামের আগে ‘শ্রী’ বসাতে হবে। যেমন, ‘শ্রী নবনীতা দেবসেন’। ‘শ্রী’ শব্দটি লক্ষ্মীর প্রতিশব্দ। সামাজিক মানদণ্ডে তার মানে হয়তো নিয়মানুগ, সুন্দর। কিন্তু সেই সুন্দরকে বৃহদার্থে নিলে তার মধ্যে আর লিঙ্গ বিভাজন থাকে না। লক্ষী মেয়ে যেমন রয়েছে, সম্ভবত বাংলা ভাষাতেই ধর্ম-লিঙ্গ নির্বিশেষে ‘লক্ষ্মী’ ছেলেদের আগেও বিশেষণ হিসেবে বসে যায় অনায়াসে।

আজকের বাঙালি কি ‘শ্রী’-হীন? তা তো নয়! অভীক মজুমদারের কথার রেশ ধরে নজর ঘোরালে দেখা যায়, জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে শ্রী দেখতে পায় বঙ্গজন। কথিত আছে কোজাগরী রাতে নাকি লক্ষ্মী স্বয়ং নেমে আসেন। বাংলার বিস্তীর্ণ মাঠের ধানে, পুষ্পে, সঞ্চয়ে, সৃজনে ‘শ্রী’-কে আজও স্বমহিমায় দেখা যায়। লক্ষ্মীমন্ত কি শুধু মেয়েরাই হবেন সে ক্ষেত্রে? লক্ষ্মী অভিধাটি তখন একটা ভাষা-ভাষীর উপরেই প্রযুক্ত। সে দিক থেকে দেখলে, বাংলার প্রতিটি সত্তাই ‘শ্রী’-যুক্ত, প্রতিটি রাতই কোজাগরী।

এই মুহূর্তে

আরও পড়ুন