কুশল দাশগুপ্ত, শিলিগুড়িঃ
পূর্ব মেদিনীপুরের দিঘায় জগন্নাথ মন্দিরের পর এ বার দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ির পালা। দুর্যোগক্লিষ্ট উত্তরবঙ্গ সফরে সরেজমিনে পরিদর্শন এবং ত্রাণ বিলির কর্মসূচির পরে বৃহস্পতিবার কলকাতায় ফেরার আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন, দার্জিলিঙের ম্যালের মহাকাল মন্দিরের মতো সমতলে নতুন একটি মহাকাল মন্দির গড়তে চান তিনি। শিলিগুড়ির আশপাশে তার জন্য জমিও দেখতে বলে দিয়েছেন। মমতা জানিয়েছেন, ওই মন্দিরে থাকবে সবচেয়ে বড় শিবমূর্তি। আপাতত শিলিগুড়ির ওই মহাকাল মন্দির পরিকল্পনার পর্যায়ে রয়েছে। তবে শীঘ্রই তা বাস্তবায়িত করতে চান মুখ্যমন্ত্রী মমতা।
আরও পড়ুনঃ শুক্লা যোগের ব্রহ্মা যোগ, প্রতিটি কাজে সফলতা এই চার রাশি
বৃহস্পতিবার দার্জিলিঙের ম্যালে বিখ্যাত মহাকাল মন্দিরে পুজো দিতে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সেখান থেকে বেরিয়ে তিনি নতুন মন্দির তৈরির কথা ঘোষণা করেন। মমতা বলেছেন, ‘‘এই মহাকাল মন্দিরে অনেক বয়স্ক মানুষ এবং বিশেষ ভাবে সক্ষমেরা আসেন। তাঁদের পক্ষে এত উপরে ওঠা সম্ভব নয়। আমি জেলা প্রশাসনকে বলেছি, জিটিএ-র তরফে ইলেকট্রিক গাড়ির ব্যবস্থা করা হবে।’’ এর পরেই নতুন পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেন, ‘‘তা ছাড়াও আমার একটা উদ্দেশ্য আছে। দিঘায় আমরা একটা জগন্নাথধাম করে দিয়েছি। রাজারহাটে একটা দুর্গাঙ্গন করছি। সেখানে ট্রাস্ট তৈরি করা আছে। জমিও চিহ্নিত করা হয়েছে। আর্কিটেকচারও আমি দেখে নিয়েছি। দার্জিলিঙের জেলাশাসককে বলেছি, শিলিগুড়ির আশপাশে একটা ভাল জমি দেখতে। সেখানে একটা কনভেনশন সেন্টার করা হবে। তার পাশেই একটা বড় মহাকাল মন্দির করব। সেখানে সবচেয়ে বড় শিবঠাকুর তৈরি করব।’’ মহাকাল মন্দির তৈরির জন্য আগে তহবিল গড়তে হবে বলেও জানান মমতা। বস্তুত, দিঘার জগন্নাথধামের আদলেই ট্রাস্ট গড়ে শিলিগুড়ির মহাকাল মন্দির তৈরি করবেন মমতা। যাতে তা নিয়ে কোনও বিতর্ক তৈরি না হয়। জগন্নাথ মন্দিরের দায়িত্ব একটি ট্রাস্টের হাতে। সেটির পরিচালন ভার ইস্কনের। তাঁর কথায়, ‘‘তার আগে (মন্দির তৈরির আগে) আমাকে একটা ট্রাস্ট করতে হবে। তাদের দিয়ে করাতে হবে। সকলকে নিয়ে আমরা নিজেরা করব।’’
আগামী বিধানসভা নির্বাচনের আগে হাতে আছে মাত্র কয়েক মাস। তৃণমূল-সহ সব রাজনৈতিক দলই নির্বাচনকে মাথায় রেখে পদক্ষেপ বিভিন্ন করছে। তবে তার মধ্যে বৃহত্তম পদক্ষেপ হল দিঘায় পুরীর ধাঁচে জগন্নাথ মন্দির। গত ৩০ এপ্রিল, অক্ষয়তৃতীয়ার দিন মমতা নিজে সেই মন্দির উদ্বোধন করেছেন। শাসকদলের বক্তব্য, দিঘায় জগন্নাথ মন্দির (পেশাকি নাম ‘জগন্নাথধাম) তৈরি মমতার ‘মাস্টারস্ট্রোক। প্রথমত, দীরের পুরীর মন্দিরকে তিনি কাছে এনে দিয়েছেন। যাতে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলার বাসিন্দারা সহজেই সেখানে যেতে পারেন। দ্বিতীয়ত, মমতা সেই মন্দিরে অধিষ্ঠিত জগন্নাথের প্রসাদ সরকারি ব্যবস্থাপনায় বিনা খরচে রাজ্যের প্রতিটি বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছেন। প্রশাসনের একাংশ এবং শাসকদলের দাবি, সেই পরিকল্পনায় ‘বিপুল সাড়া’ মিলেছে। যদিও অনেকের মতে, বিধানসভা ভোটে হিন্দু ভোট নিশ্চিত করতে মমতা ওই পদক্ষেপ করেছেন। সেই জল্পনা আরও বাড়িয়েছিল মমতার নিউ টাউনে ‘দুর্গাঙ্গন’ তৈরির ঘোষণা। তাতে নতুন মাত্র যোগ করল শিলিগুড়িতে মহাকাল মন্দির তৈরির পরিকল্পনা।
এমনিতেই উত্তরবঙ্গের মাটিতে বিজেপি এখনও তৃণমূলের তুলনায় শক্তিশালী। ২০২৬ সালের ভোটে তৃণমূলকে ভোটে যেতে হবে তিন মেয়াদে ১৫ বছরের প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার ‘বোঝা’ মাথায় নিয়ে। অন্যদিকে, বিজেপি যে ধর্মীয় মেরুকণের তাস খেলবে, তা নিয়ে তাদের প্রধান নেতা শুভেন্দু অধিকারী কোনও রাখঢাক করছেন না। রাজ্যের এক মন্ত্রীর কথায়, ‘‘মুসলিম ভোট আমাদের ফিক্সড ডিপোজ়িট করা আছে। কারেন্ট অ্যাকাউন্টের ভোটটা ঠিকঠাক রাখতে পারলেই চিন্তা নেই।’’ সেই ‘কারেন্ট অ্যাকাউন্ট’ বলতে তিনি হিন্দু ভোটকেই বুঝিয়েছেন।
আরও পড়ুনঃ ববির কপালে কি? ছাব্বিশের ভোটের আগেই তৃণমূলে ঝাঁকুনি দিতে বড় রদবদল পুরসভায়
শিলিগুড়ি শহরে অবাঙালিদের বসবাস ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। প্রত্যাশিত ভাবেই বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীন দল তাঁদের সন্তুষ্ট রাখতে চেষ্টা করেছে। সিপিএম আমলে যে কারণে শিলিগুড়ির বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্যকে কটাক্ষ করে ‘অশোক আগরওয়াল’ বলে ডাকা হত। আশ্চর্য নয় যে, মমতা শিলিগুড়ির সেই অংশকে কাছে টানার চেষ্টা করবেন। অনেকের মতে, মহাকাল মন্দির তৈরির ঘোষণা তারই প্রথম পদক্ষেপ।
মমতার পরিকল্পনাকে প্রত্যাশিত ভাবেই কটাক্ষ করতে ছাড়েনি বিজেপি। শিলিগুড়ির বিধায়ক শঙ্কর (ঘটনাচক্রে, তাঁর নামের অর্থও ‘শিব’ বা ‘মহাদেব’) ঘোষ জানিয়েছেন, সরকারের টাকায় মন্দির তৈরি করা যায় না। তাঁর কথায়, ‘‘সরকারি অর্থে মন্দির বা ধর্মস্থান বানানো যায় না। ওটা সরকারের কাজ নয়। অযোধ্যায় এত বড় রামমন্দির হয়েছে। তা-ও কিন্তু সরকারের পয়সায় হয়নি। রামভক্তদের দেওয়া অর্থে হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী দিঘায় যা করেছেন, এখানেও তা-ই করবেন। আইন বাঁচাতে সরকারি অর্থে ‘সাংস্কৃতিক কেন্দ্র’ তৈরি করবেন। তার মধ্যে একটা মন্দির থাকবে। এটা আসলে স্বয়ং ভগবানকে অপমান করা।’’
একধাপ এগিয়ে বিজেপির বিধায়ক শঙ্কর বলেছেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ধর্মীয় পরিচয় সম্পর্কে মানুষের মনে প্রশ্ন জাগছে। তাই তিনি এই সমস্ত ঘোষণা করছেন। ২০২৬ সালে ওঁর সরকার পড়ে যাবে। তার পরে প্রয়োজনে আমরা শিবভক্তদের অর্থে মহাকাল মন্দির গড়ে দেব।’’ অর্থাৎ, দিঘার মন্দিরের মতোই শিলিগুড়ির প্রস্তাবিত মন্দির গড়া নিয়ে শঙ্কর কিছু বলতে পারেননি। বিজেপির পক্ষে তা রাজনৈতিক ভাবে সম্ভবও নয়। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন ‘পদ্ধতি’ নিয়ে। যে প্রশ্নের জবাব ‘ট্রাস্ট’ গঠনের পরিকল্পনার কথা বলে দিয়েছেন মমতা স্বয়ং।