প্রশাসনিক বৈঠক তো নয় যেন পড়া ধরা! উত্তরকন্যার ৯০ মিনিটের প্রশাসনিক মিটিংয়ে জেলা ধরে ধরে উন্নয়নের কাজ খতিয়ে দেখলেন রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান।
সেখানে পুলিশের একাংশের লবি বাজি থেকে সরকারি কাজের গড়িমসি, শুরু থেকেই একের পর এক প্রশ্ন তোলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বৈঠকের শেষ মুহূর্তে ধমক দেন রাজ্যে পুলিশের সর্বোচ্চ কর্তা (ডিজি) রাজীব কুমারকেও। ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রীকে বলতে শোনা যায়, “বলতে বলতে জিভ ক্ষয়ে গেল! আর কতবার বলতে হবে?’
আরও পড়ুন: কত টুকরো হবে পাকিস্তান! ৪ দিন ধরে জ্বলছে সিন্ধ, আগুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়িতে
এদিনের প্রশাসনিক বৈঠকের একেবারে শেষে বলতে ওঠেন কোচবিহারের সাংসদ জগদীশ বাসুনিয়া। তিনি বলেন, “গ্রামে গঞ্জে নতুন রাস্তা তৈরি করতে দিয়ে পুরনো রাস্তা ভেঙে যাচ্ছে। কারণ এত বেশি লোডেড ট্রাক ঢোকানো হচ্ছে…’!
সাংসদের কথা শেষ হওয়ার আগেই ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী বলতে শুরু করেন, “আমি তো বারংবার বলেছি, গ্রামীণ রাস্তায় লোডেড ট্রাক যাবে না। কেন পুলিশ এটা করছে না? রাজীব (ডিজি) আমি আর কতবার বলব? ” দৃশ্যতই অপ্রস্তুত দেখায় ডিজিকে। তিনি এ সময় বলার চেষ্টা করেন, “বিষয়টি আমি দেখি নিচ্ছি ম্যাডাম।”
যা শুনে ক্ষোভের জ্বালামুখ খুলে দেন রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান। রাগে গজগজ করতে করতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “বারবার বলা হয়েছে, গ্রামীণ রাস্তায় লোডেড ট্রাক ঢোকাবেন না। টাকা নেই তা সত্ত্বেও আমরা কাজ করছি, আর এভাবে সেই রাস্তাগুলো ভেঙে দিচ্ছে, এক কথা বারবার বলতে ভাল লাগে না। বলতে বলতে আমার জিভটা ক্ষয়ে গেল!”
আরও পড়ুন: কত টুকরো হবে পাকিস্তান! ৪ দিন ধরে জ্বলছে সিন্ধ, আগুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়িতে
আলিপুরদুয়ারের জেলাশাসকের কাছে মুখ্যমন্ত্রী জানতে চান, যেগুলো লোকালি স্টাডি করলে হয়ে যায়, সেগুলো কেন করছেন না? পাবলিকের কাগজগুলো কি আপনারা উল্টে দেখেনও না? সময়ের কাজ তো সময়ে করতে হবে। করছি বলে তো বছরের পর বছর তো চলে যেতে পারে।
মনে করিয়ে দেন, “আমি শুধু আলিপুরদুয়ার না, প্রত্যেকটা জেলাকে বলছি। কমপ্লেন কিন্তু প্রচুর আসছে? ভাষণ না দিয়ে কাজ করুন।”
এরপরই পুলিশের লবিবাজি নিয়ে সরব হতে দেখা যায় রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানকে। ভরা বৈঠকে হঠাৎই কোচবিহারের ডিএসপি হেডকোয়াটার্স এর খোঁজ করেন মুখ্যমন্ত্রী। দেখা যায় তিনি বৈঠকে নেই। এরপরই জেলার পুলিশ সুপারের উদ্দেশে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “কোচবিহারের ডিএসপি হেডকোয়াটার্সকে কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না। তোমরা কাজ করতে দাও না। তোমরা নিজেরাই যদি নিজেদের মধ্যে গ্রুপ করে নাও, তাহলে কি করে হবে? সে কাজ করতে চায়, তবু কাজ করতে দেবে না, এ আবার কী! পুলিশ কি নিজেদের মধ্যে গ্রুপ করে? গ্রুপ তো পলিটিক্যাল লিডাররা করে! এটাই এতদিন জেনে এসেছি।”
আরও পড়ুন: জিএসটির পরও আলাদা ট্যাক্স কীসের? আর কত চাই? মমতার নিশানায় কেন্দ্র
মুখ্যমন্ত্রী এও বলেন, “আমি জানি কোনও কোনও সংবাদমাধ্যম এটা নিয়ে ন্যারেটিভ করার চেষ্টা করবে, তাদের বলব, এটা প্রশাসনিক মিটিং, আশা করব, এটা নিয়ে কাউকে ছোট, বড় করবেন না।”
মালদহের পুলিশ সুপারের উদ্দেশে মুখ্যমন্ত্রী জানতে চান, “মালদহেই দাঙ্গা কেন হয়? অপারেশন দাঙ্গা কেন হবে?” খানিক থেমে বলেন, “কোথাও যেন কমিউনাল টেনশন না হয়, আই বিকে আরও অ্যাক্টিভ হতে হবে, ভিলেজ পুলিশ এ কারণেই তৈরি করা হয়েছিল। প্রো অ্যাক্টিভ হতে হবে। মনে রাখবেন দক্ষিণবঙ্গ উত্তরবঙ্গ সবাই এক। এলাকার শান্তি বজায় রাখায় আমাদের প্রধান কর্তব্য।”
উত্তরবঙ্গের জেলার স্বাস্থ্য আধিকারিকদের উদ্দেশে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করিয়ে দেন, “অনেকগুলো ওষুধ বাদ দেওয়া হয়েছে, সেগুলো যাতে হাসপাতালে না থাকে, ওষুধের এক্সপারি ডেট পেরিয়ে গেছে কিনা, এগুলো দেখার জন্য নিয়মিত সারপ্রাইজ ভিজিট করতে হবে।”
সরকারি কাজের গড়িমসি নিয়েও প্রশ্ন তোলেন রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান। মমতার কথায়, টেন্ডার ডাকতে ৩ মাস, শর্ট আউট করতে আরও ৪ মাস, এই গয়ংগচ্ছ মনোভাব বন্ধ করতে হবে। বহু এলাকায় পাইপ যাওয়ার পরও জল পৌঁছছে না। মুখ্যমন্ত্রীর সাফ কথা, “ফিল্ড ইন্সপেকশন বাড়াতে হবে। শুধু তথ্য নিলে হবে না, কাজটাও ঠিকভাবে করতে হবে।”
উন্নয়নের নামে পুরসভা বা কর্পোরেশনগুলো একের বেশি ট্যাক্স নিতে পারবে না বলেও জানিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী। একই সঙ্গে দার্জিলিং টি এর নাম ভাঙিয়ে নেপাল ভেজাল চা মেশাচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ ব্যাপারে উত্তরের জেলা প্রশাসনকে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “দার্জিলিং টি-র ব্র্যান্ড ওরা ব্যবহার করতে পারে না, এটা ইললিগ্যাল। বর্ডারে মেশিন লাগাও, চেক করো।”
ক্লাসের কড়া দিদিমনির স্টাইলে একেবারে নোট ধরে ধরে পড়া ধরেছেন মুখ্যমন্ত্রী। মনে করিয়েছেন, “আন্দাজেও মিটিং করতে পারতাম, কিন্তু আমি কাগজ স্টাডি করে এসেছি।”