‘পাহাড় আঁকা কত সোজা। হারিয়ে গেছে সেই ড্রয়িং খাতা…’ সত্যিই হারিয়ে গিয়েছে সেই আঁকার খাতা। বছর পনেরো আগে মহানন্দার ধারে কোয়ার্টারের জানলায় বসে যে খাতায় ধরে রাখার চেষ্টা করেছিলাম এক চিলতে দেখতে পাওয়া কাঞ্চনজঙ্ঘাকে। তখনও ছিল বৈশাখ। অঞ্জন দত্তের দুষ্টু দো-দো শিরিঙের দেখা না-পেলেও আমার শৈশবের দার্জিলিংটা…. থুড়ি শিলিগুড়িটা বেশ বদলে গিয়েছে। সেই সঙ্গে তার বৈশাখী হাওয়াও। শিলিগুড়িতে তখন সারাবছরই গায়ে চাদর দিয়ে শুতে হতো।
কাকাই’দের তিস্তাপল্লির কোয়ার্টার থেকে হামেশাই দেখা দিত কাঞ্চনজঙ্ঘা। সেখানে কাটানো দু’একটা পয়লা বৈশাখে আনন্দ ছিল অনাবিল। সন্ধে নামতেই বিধান মার্কেট, মহাবীরস্থানে লাইন। বড়রা খাতার হাল, টাকা-পয়সার আঁক নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও ছোটদের মন থাকত আইসক্রিম-মিষ্টিতে। এখন? কলকাতার পচা গরমে ‘এসো হে বৈশাখ’ গাওয়াও যেন দুর্বিষহ।
আরও পড়ুন: পয়লা বৈশাখে দুই প্রবীণের কামড়াকামড়ি, রক্তারক্তি কাণ্ড হুগলিতে
দশক পেরিয়ে চাকরি সূত্রে এমনই এক বৈশাখী দিনে ফের পা পড়ল শিলিগুড়িতে। শহরটার গতি অনেকখানি বেড়ে গেলেও উত্তুরে হাওয়া ভারি কৃপণ হয়ে গিয়েছে। কমে গিয়েছে হালখাতার উদ্দীপনা, চৈত্র সেলে কেনাকাটার হিড়িক। কারণ শপিং মলগুলোয় এখন সারাবছরই ‘চৈত্র সেল’।
শুধু ছাড়ের শতাংশটা থামোমিটারের পারদের মতো ওঠানামা করে। আর এ দিকে, শিলিগুড়ির ঠান্ডা আবহাওয়া নিয়ে বাড়িতে রীতিমতো ঝগড়া করে আসার পর, ‘ভুল হয়ে গিয়েছে’ মালুম হলো নববর্ষের প্রথম হপ্তাতেই। দুপুর গড়াতেই বন্ধুর ফোন।
‘কী রে! বেরোবি নাকি?’ আগে শিলিগুড়ির বৈশাখী বিকেলে নামত অকাল-শ্রাবণ। তিনবাতির ধোঁয়া-ওঠা মোমোর স্বাদই ছিল আলাদা! আর এখন? মোমো খেতে গেলে ঠান্ডা হাওয়ার দরকার হয় না। ঠান্ডা ঘরই কাফি। চলল কথোপকথন। ‘চৈত্র সেলে কী কেনাকাটা করলি?
আরও পড়ুন: আজ বাঙালির পয়লা বৈশাখ; বাঙালির ছক্কা হাঁকানোর দিন, কাল যা হবে দেখা যাবে
উত্তরে ‘এসব এখন ব্যাকডেটেড। সারাবছরই তো মলগুলোয় সেল চলে। চল যাই।’ অটো ছুটল মাটিগাড়ার দিকে। শপিং মলের চোখধাঁধানো আলোয় ভেসে উঠল একফালি অতীত। এই মাটিতেই তো পিঠে ঝুড়ি নিয়ে পাতা তুলত মেয়েরা! এই পয়লা বৈশাখ ওদের ভালো কেটেছে? নাকি পিষে গিয়েছে শহুরে গতির জাঁতাকলে। ঠিক যেমন আপ টু সেভেন্টি পার্সেন্টের হুঙ্কারে চাপা পড়েছে চৈত্র সেলের হাঁক। এখন শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত মলে বসে ‘চৈত্র সেল’। ওই মল গড়তে ওখান থেকে যাদের চলে যেতে হলো, তাদের কথা মনে পড়ল। সেখানে ধুলো-মাটি মেখে খেলত যে শিশুরা! আচ্ছা, বাংলা বছরের পয়লা দিনে ওরা কি কাউকে বলতে পারল ‘শুভ নববর্ষ’?