কুশল দাশগুপ্ত, শিলিগুড়ি:
হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালাকে খুঁজে দিন। মাত্র চারটে শব্দের এই বিজ্ঞাপন এখনও কোথাও প্রকাশিত হয়নি বটে, তবে যে কোনও দিন শিলিগুড়ি পুরসভা এমন একটা বিজ্ঞাপন দিলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
আরও পড়ুন: শিলিগুড়িতে শুটআউট! মাদক কারবারীদের সঙ্গে পুলিশের বচসা
জার্মানির হানোভারের ৩৩ মাইল দক্ষিণে ছোট্ট শহর হ্যামলিন। ইঁদুরের অত্যাচার থেকে বাঁচতে মোটা অঙ্কের পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা করেন মেয়র। সেই ঘোষণায় সাড়া দিয়ে শহরে এসে হাজির হয় রহস্যময় এক বাঁশিওয়ালা।
তিনি মায়াবী সুরের জাদুতে শহরের সব ইঁদুরকে ওয়েজার নদীতে নিয়ে গিয়ে ফেলেছিলেন। শিলিগুড়িরও এখন চাই একটা হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা। যিনি শহরের সমস্ত ইঁদুরকে মহানন্দার জলে ডোবাতে পারেন। এ ছাড়া এ শহরকে রক্ষা করা বড্ড কঠিন।
শহরের সমস্ত নালা-নর্দমা, বাজার-ঘাট ভরে গিয়েছে ইঁদুরে। হিলকার্ট রোডের ফুটপাথ মাটির নীচে বসে যাচ্ছে। একই হাল শহরের স্টেশন ফিডার রোড, বিধান রোড, সেবক রোডেরও। পূর্ত দপ্তরের এক ইঞ্জিনিয়ারের কথায়, ‘এমন হতেই পারে যে একদিন হিলকার্ট রোডের সমস্ত নালা একসঙ্গে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল। ইঁদুরের পাল এমন করেছে যে নতুন করে ফের ওই নিকাশি নালা তৈরি করা ছাড়া বিকল্প উপায় নেই।’
শিলিগুড়ির বাসিন্দাদের একটা বদভ্যাস হলো, অভুক্ত খাবার ড্রেনে ফেলে দেওয়া। হোটেল, রেস্তোরাঁ, মিষ্টির দোকানের অবিক্রিত খাবারও ড্রেনে গিয়ে জমা হচ্ছে। চালের গুদামের আশপাশে যেন ভারত-বাংলাদেশের চোরাকারবারীদের গোপন রাস্তা।
কয়েকদিন আগে আমার স্ত্রী ঘরের দরজা খুলতে দেখেন প্রায় খরগোশের সাইজ়ের একটা ইঁদুর। খাবারের খোঁজে ড্রেন ধরে ধরে ইঁদুরগুলো গোটা শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিধান মার্কেটে গিয়ে চায়ের দোকানে বসেও স্বস্তি নেই, পায়ের নীচে সবসময়ে ঘুরছে
গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য, ভ্রমণ লেখক
আরও পড়ুন: চোর বলে কি মানুষ নয়! তার কি খিদে পেতে পারে না! খেয়েদেয়ে চুরি করে নিঃশব্দে পালিয়ে গেল চোর
চাল-গমের বস্তা কেটে খাবার বার করে নিয়ে জমা করছে মাটির তলায়। বিধান মার্কেটের মুরগি হাটিতে রাত নামলেই দেখা যায় প্রায় বিড়ালের আকারের বেড়ে ইঁদুর। সেই ইঁদুর দেখলে যানবাহনের চাপে ভারাক্রান্ত সড়কের নীচের অংশ কি ফোঁপরা করে দিচ্ছে ইঁদুরের দল।
উল্টোপথে হাঁটা দেয় বিড়ালও। শহরের প্রধান সড়ক, বাজার ছাড়িয়ে পাড়াতেও হানা দিয়েছে ইঁদুর। খোদ কলেজপাড়ায় এখন নিত্য ইঁদুরের উৎপাত। একই অভিযোগ, হাকিমপাড়া, মহানন্দাপাড়া, দেশবন্ধুপাড়া, পূর্ব বিবেকানন্দ পল্লির বাসিন্দাদেরও।
শহরের মেয়র গৌতম দেবের আক্ষেপ, ‘আমার বাড়ির সামনেই ইঁদুর মাটি খুঁড়ে গর্ত করে দিচ্ছে। আমি বন্ধ করার চেষ্টা করছি। লোকজনকেও অনুরোধ করেছি, খাবার রাস্তায় ফেলবেন না।’
শিলিগুড়ির হাকিমপাড়ার বাসিন্দা প্রখ্যাত ভ্রমণ লেখক গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘কয়েকদিন আগে আমার স্ত্রী ঘরের দরজা খুলতেই দেখেন প্রায় খরগোশের সাইজ়ের একটা ইঁদুর। খাবারের খোঁজে ড্রেন ধরে ধরে ইঁদুরগুলো গোটা শহর ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিধান মার্কেটে গিয়ে চায়ের দোকানে বসেও স্বস্তি নেই, পায়ের নীচে ঘুরছে।’
বিধান মার্কেটের প্রায় প্রতিটি দোকানেই রয়েছে ইঁদুর ধরার খাঁচা। তাতেও রেহাই নেই। বাজারের এক চাল দোকানি ধরম পাশোয়ান বলেছেন, ‘আমি দোকানে এখন চাল স্টক করাই ছেড়ে দিয়েছি। অর্ডার নিয়ে মহাজনের গুদাম থেকে চাল সরাসরি ক্রেতার বাড়ি অথবা দোকানে পৌঁছে দিই। না-হলে তো ফতুর হয়ে যাব।’
ইঁদুরের যে যম ছিল সেই পেঁচা বহুতলের দাপটে উধাও হয়েছে অনেক আগে। একে একে হারিয়ে যাচ্ছে পুরোনো বাড়ি। তার সঙ্গে পেঁচাও। এখন শহরের নানা পেস্ট কন্ট্রোল সংস্থা গজিয়ে উঠেছে। তাঁরা কয়েক হাজার টাকার বিনিময়ে বাড়িতে গিয়ে ইঁদুর তাড়াচ্ছে। তাতে সমস্যা মিটছে না।
মেয়র অবশ্য এই ব্যাপারে তাড়াহুড়ো করতে চান না। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে এগোতে চান। তিনি বলেন, ‘গোটা শহরে ইঁদুর বাড়ছে। ড্রেনে খাবার ফেললে বাড়বেই। কীটনাশক দিয়ে ইঁদুর মারা উচিত হবে না। তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। বিকল্প ভাবতে হবে আমাদের।’