‘তখন আমার বয়স ছিল পাঁচ বছর। পড়তাম ভোপালের কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ে। সেই সময় প্রথম শুনি বিখ্যাত একটি হিন্দি গান। যার কথাগুলি ছিল, ‘ওয়াক্ত কি আওয়াজ হ্যায় মিল কে চলো’। যে গান পরবর্তী কয়েক দশক ধরে জাতীয়তাবোধ ও সংগ্রামের এক শেকল ছেঁড়ার গান হয়ে বেঁচে রয়েছে। ভারতীয় গণসঙ্গীত জগতের ‘ফার্স্ট লেডি ‘ রুমা গুহঠাকুরতা সম্পর্কে একথাই লিখেছিলেন বিনায়ক লোহানি। আইআইটি খড়্গপুর ও আইআইএম কলকাতার প্রাক্তনী বিনায়ক রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের ভাবাদর্শে মানবধর্ম রক্ষার কাজে পরে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন।
সেদিনের একটা প্রজন্ম ছিল যারা দূরদর্শন দেখে বড় হয়ে উঠেছে। সেই সময় মাঝেমধ্যেই দেখা যেত সমবেত সঙ্গীত বা গণসঙ্গীতের অনুষ্ঠান। একধারে সার দিয়ে পাজামা-পাঞ্জাবি পরা যুবকের দল। অন্য ধারে শাড়ি পরা নানা বয়সি মহিলা। একপাশে দাঁড়িয়ে হারমোনিয়াম দিয়ে লিড দিচ্ছেন যিনি, মধ্যবয়সি সেই মহিলার নাম রুমা গুহঠাকুরতা। যিনি নিজেই নিজের পরিচয়। কাউকে বলতে হতো না ইনি সত্যজিৎ রায়ের ভাগ্নী, কিংবা তার থেকে বড় পরিচয় কিশোর কুমারের প্রথম স্ত্রী, অমিত কুমারের মা।
আরও পড়ুন: অন্ধকার সময়েও পথ দেখাবে, বাবা লোকনাথ
শুধু গণসঙ্গীত কিংবা লোকসঙ্গীত ছাড়াও রুমা গুহঠাকুরতা ছিলেন অভিনয় জগতের দিকপাল শিল্পী। হিন্দি ও বাংলা দুটি ভাষাতেই ছিলেন সাবলীল। ৮৮ বছরে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যারের জন্মদাত্রী এই মহিলা একসঙ্গে গান ও সিনেমায় অভিনয় চালিয়ে গিয়েছেন সব্যসাচীর মতো। জাতীয় সংবাদ মাধ্যমের কাছে তাঁর পরিচয় কিশোরের স্ত্রী হিসেবে থেকে গেলেও তার চেয়ে অনেক বড় আত্মপরিচয় তিনি নিজেই বয়ে বেড়িয়েছেন।
রুমা যখন ছোট ছিলেন, তখন থেকেই তিনি তৎকালীন বম্বের ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের (IPTA) সক্রিয় ‘কর্মী’ ছিলেন। সে সময় বম্বের IPTA-এর সুখ্যাতি ছিল ভারত জোড়া। বিশিষ্ট সব শিল্পী-অভিনেতারা যুক্ত ছিলেন এখানে। বম্বেতেই রুমা উস্তাদ আবদুল রহমান খানের কাছে তালিম নেন। কিশোরী বয়সেই রুমাদেবী নামে হিন্দি ছবিতে কাজ করেছিলেন। যেমন- প্রথম পর্দায় আসেন অমিয় চক্রবর্তীর নির্দেশনায় ১৯৪৪ ‘জোয়ার ভাটা’ সিনেমায়। এই ছবিতেই প্রথম বম্বেতে পা রাখেন খোদ দিলীপ কুমারও। নীতিন বসুর (যাঁকে স্বয়ং দিলীপ কুমার নিজের গুরু বলে মানতেন) ‘মশাল’, চেতন আনন্দের ‘আফসার’।
১৬ বছর বয়সে একদিন বম্ব টকিজের তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় আভাসকুমার গঙ্গোপাধ্যায়ের। অশোক কুমার-কিশোর কুমারদের সবথেকে ছোট ভাই ছিলেন আভাস। রুমা ও কিশোরের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে ১৯৫৮ সালে। তখন তিনি অরূপ গুহঠাকুরতার সাহায্যে গণসঙ্গীতের গ্রুপ তৈরি করেন। সেই সময় এদেশে এক মহিলার তৈরি কয়্যার গ্রুপের কথা কেউ ভাবতেই পারত না। এর আগে সলিল চৌধুরী গণনাট্য সঙ্ঘের সদস্য হলেও বম্বে কয়্যার নামে একটি গণসঙ্গীতের গ্রুপ খুলেছিলেন।
কিন্তু, ১৯৫৮ সালে সলিল চৌধুরী যখন হিন্দি সুরের জগতে মিশে গেলেন, তখন তিনি রুমার হাতে এই দায়িত্ব সঁপে দিয়ে যান। এবং সত্যজিৎ রায়ের উৎসাহে রুমা গড়ে তোলেন ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যার। প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে নাম ছিল সলিল চৌধুরী ও সত্যজিৎ রায়ের। এবং সত্যজিৎ রায়ই ছিলেন প্রথম সভাপতি।
আরও পড়ুন: স্মার্ট বিভ্রাট! বিল বেশি আসবে না কম!
ইয়ুথ কয়্যার প্রায় ৬০ বছর ধরে দেশবিদেশে কম করে হলেও ৫০০০টি শো করেছে। ১৯৪৮ সালে সলিল চৌধুরীর লেখা ‘আমার প্রতিবাদের ভাষা’, শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আজ যত যুদ্ধবাজের’ সুর দিয়েছিলেন ভি বালসারা। অথবা ভূপেন হাজারিকার গান গঙ্গা আমার মা। রুমা সময়ে সময়ে পল রোবসন, পিট সিগারের গানেরও নবরূপদান করেছেন। ১৯৯০ সালে নেলসন ম্যান্ডেলার কলকাতা সফরের আগের দিন রাতে তৈরি হয় স্বাগত ম্যান্ডেলা গানটি।
সত্যজিৎ রায়ের অভিযান ও গণশত্রুতে অভিনয় করা ছাড়াও অসংখ্য হিন্দি ও বাংলা ছবিতে সাড়া জাগানো অভিনয় করেছিলেন রুমা। তার মধ্যে একটি হল, দিলীপ রায়ের পরিচালনায় অমৃতকুম্ভের সন্ধানে। বিনায়ক একটি নিবন্ধে লিখেছিলেন, আমার মতো যারা ভোপালে বড় হয়েছে, তারা জানে রুমাই ভোপালের ১২ বছরের একটি বাচ্চা মেয়েকে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, যাঁর নাম জয়া ভাদুড়ি। জয়া ভাদুড়ি সপরিবারে কলকাতা ঘুরতে যাওয়ার সময় রুমাই সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে তাঁদের পরিচয় করিয়ে দেন। এবং যার ফল হয় ‘মহানগর’ সিনেমায় জয়ার আত্মপ্রকাশ।