২০০৯ সালের ঘটনা। দ্বিতীয় বার রেলমন্ত্রী হয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । সংসদের ক্যান্টিন তখন চালাত নর্দার্ন রেল। বাংলা ও বাঙালিকে দিল্লিতে অধিষ্ঠিত করার একটা তাড়না বরাবরই মমতার রয়েছে। তিনি ঠিক করলেন, সংসদ ভবনের ক্যান্টিনেও বাঙালির পছন্দের মাছ-ভাত থাকা উচিত। বাঙালি সাংসদ, সাংবাদিকরা তো বটেই, সংসদ ভবনের বাঙালি অফিসার কর্মীরাও তাতে রসনা তৃপ্ত করতে পারবেন। আবার অবাঙালিদের মধ্যে যাঁরা আমিষ খান, তাঁরাও স্বাদ নিতে পারবেন মাছ ভাতের। সংসদের ক্যান্টিনে বাঙালি রান্নার জন্য তাই হাওড়ার রেল ক্যান্টিনের রাঁধুনি বেণুধর প্রধানকে দিল্লিতে নিয়ে গিয়েছিলেন দিদি।
পুরো ব্যাপারটাই ছিল সরকারি। বেণুধরও ছিলেন রেল-নিযুক্ত সরকারি রাঁধুনি। সর্ষে দিয়ে রুই মাছের কালিয়া বেড়ে রান্না করতেন বেণুধর। কিন্তু পনেরো বছর পর এবার, সংসদে বাঙালি ‘সন্দেশ’ ঢোকাতে গিয়ে কেলেঙ্কারি ঘটে গেল। সেই সন্দেশকে ঘিরে বাংলায় শাসক দলের দুই সাংসদের মধ্যে এমন তর্ক বেঁধেছে, যে তার রস (পড়ুন জল) গড়িয়ে এল কলকাতাতেও। তৃণমূলের মধ্যে এখন তা নিয়েও সরস আলোচনা চলছে। তৃণমূলের এই দুই সাংসদ হলেন কীর্তি আজাদ ও কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় ।
ব্যাপারটা এই রকম। দিল্লিতে প্রবাসী বাঙালিদের গত প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে ঠিকানা হল চিত্তরঞ্জন পার্ক। পূর্ব পাকিস্তান থেকে উচ্ছেদ হওয়া পরিবারকে সেখানে স্বল্পমূল্যে জমি দেওয়া হয়েছিল। অধুনা চিত্তরঞ্জন পার্ক দিল্লির অন্যতম অভিজাত এলাকা। তার এক নম্বর মার্কেট ও দু’নম্বর মার্কেট হল দিল্লির তামাম বাঙালির মক্কা। পাবদা, ট্যাংরা, মৌরলা, ইলিশ থেকে শুরু করে গাওয়া ঘি, পোস্ত, গয়না বড়ি কী না পাওয়া যায় সেখানে! এক নম্বর মার্কেটের অদূরে পকেট ফরটির সামনে গত বিশ বছর ধরে একটা বাঙালি মিষ্টির দোকানও রয়েছে। নাম কমলা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। কমলার মালিক বর্ধমানের লোক। মিষ্টিও বেশ স্বাদু।
কিছুদিন হল, চিত্তরঞ্জন পার্কের ই ব্লকে আরও একটা বাঙালি মিষ্টির দোকান খুলেছে। তার নাম ‘সন্দেশ’ । কোনও এক বাঙালি আমলার স্ত্রী এই দোকান চালান বলে খবর। তৃণমূল সূত্রে জানা গিয়েছে, এই সন্দেশের একটা আউটলেট সংসদ ভবনের মধ্যে খোলার জন্য তদ্বির করতে শুরু করেছিলেন দুর্গাপুরের তৃণমূল সাংসদ কীর্তি আজাদ। বাংলা ও বাঙালি মন্ত্রে এ ব্যাপারে তৃণমূলের লোকসভার সাংসদদের থেকে সই সংগ্রহও শুরু করেছিলেন কীর্তি।
আরও পড়ুন: খড়দহে বিধবা মহিলাকে গণধর্ষণের অভিযোগ, গ্রেফতার ২, বাকি ২ পলাতক
দুর্গাপুরের সাংসদের এই কীর্তির কথা শুনেই প্রশ্ন তোলেন কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় । লোকসভায় তৃণমূল কংগ্রেসের মুখ্য সচেতক তথা চিফ হুইপ হলেন তিনি। কল্যাণ কীর্তিকে প্রশ্ন করেন, ‘এটা কী করছেন? আমরা কেন একটা বাইরের মিষ্টির দোকানের জন্য তদ্বির করব? এটা কি আমাদের কাজ? আমাদের সরকারেরই তো ব্র্যান্ড রয়েছে ‘বিশ্ব বাংলা’। তদ্বির যদি করতেই হয় ‘বিশ্ব বাংলার’ জন্য করব।’ জানা গিয়েছে, এ নিয়ে এক প্রস্ত বচসা হয় দুজনের মধ্যে।
এই তথ্যের সত্যতা জানতে কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে ফোন করা হলে তিনি ‘বঙ্গবার্তা’কে বলেন, ‘হ্যাঁ ঠিকই শুনেছেন। আমরা কেন কোথাকার কোন সন্দেশের জন্য তদ্বির করব। সংসদে বিশ্ব বাংলার আউটলেট খোলার জন্য তদ্বির করলে আপত্তি করতাম না।’ বঙ্গবার্তার থেকে ফোন করা হয়েছিল দুর্গাপুরের সাংসদ কীর্তি আজাদকেও। তিনি সবটা শুনে বলেন, ‘এরকম কিছু ঘটেনি।’ তাঁকে ফের প্রশ্ন করা হলে, তিনি পুনরায় বলেন, ‘এরকম কিছু ঘটেনি।’
এদিকে এ ঘটনার পরদিনই দিল্লিতে নির্বাচন কমিশনের সামনে কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও কৃষ্ণনগরের তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্রর মধ্যে তুমুল বচসা হয়। সেই বচসার নেপথ্যে ছিল পারস্পরিক সমন্বয়ের অভাব। সূত্রের দাবি, তা নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সামনে কল্যাণের উপর এমন ভাবে চড়াও হন মহুয়া, যে কল্যাণও মাথা ঠান্ডা রাখতে পারেননি। দু-চার কথা তিনিও শুনিয়ে দেন। তার পরেই আবার নিরাপত্তা কর্মীদের উদ্দেশে মহুয়া বলতে শুরু করেন, আমাকে হেনস্থা করা হচ্ছে, ওঁকে গ্রেফতার করুন। সে ছিল এক নাটকীয় পরিস্থিতি।
আরও পড়ুন: স্বস্তিতে মমতা ও রাজ্য মন্ত্রিসভা; অতিরিক্ত শূন্যপদ তৈরির ঘটনায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ খারিজ
সূত্রের খবর, ওই ঘটনার সময়ে মহুয়ার পক্ষ নেন কীর্তি আজাদ । তাতে আরও তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন কল্যাণ। তৃণমূলের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মধ্যেই এর পর কীর্তির উদ্দেশে সরাসরি আক্রমণাত্মক হন শ্রীরামপুরের তৃণমূল সাংসদ। এও লেখেন, ‘বিজেপির ভিতরে দলাদলি করার জন্যই আপনাকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। সেটাই এখন তৃণমূলে শুরু করেছেন। গতকাল দলকে বেচে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন আপনি। দুর্গাপুরে গিয়ে আপনার মুখোশ খুলে দেব।’
অনেকে মনে করছেন, দলকে বেচে দেওয়া বলতে কল্যাণ ‘সন্দেশ পর্বের’ খোঁচা দিতে চেয়েছিলেন। ওই হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটে কীর্তিকেও জবাব দিতে দেখা যায়। তিনি বলেন, ‘টেক ইট ইজি কল্যাণ। তুমি এই বালখিল্যতা বন্ধ করো। পূর্ণবয়স্কের মতো ব্যবহার করো।’
শোনা যাচ্ছে, কল্যাণ নাকি এখনও ব্যাপারটা ‘ইজি ভাবে’ নিতে পারেননি। গজগজ করেই যাচ্ছেন।