কুশাল দাশগুপ্ত, শিলিগুড়িঃ
বেশ কিছুদিন ধরেই একটি রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানির পাইপ লাইনের কাজ চলছে ডুয়ার্সের গাঠিয়া নদীতে। খরস্রোতা নদীতে নেমে কাজ করতে গিয়ে বিপর্যয় নেমে আসবে তা কস্মিনকালেও ভাবেননি কর্মীরা। মঙ্গলবার বিকেলে আচমকাই নদীতে চলে এল হড়পা বান। নদীর মাঝে দ্বীপের মতো একটি উঁচু জায়গায় আশ্রয় নিলেন তিন শ্রমিক। তাঁদের বাঁচাতে স্থানীয় বাসিন্দারা ও প্রশাসনের তরফে শুরু হয়ে গেল মরীয়া প্রয়াস।
আরও পড়ুনঃ সকাল থেকে তীব্র রোদ! ভাবলে চলবে না আকাশের মুড বদলে গিয়েছে; ফের চোখ পাকাবে নিম্নচাপ
জানা গিয়েছে, একটি রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানীর পাইপ লাইনের কাজে গাঠিয়া নদীতে নেমেছিলেন বিহারের বাসিন্দা মোহন সিং (৪৫), যোগেশ কুমার গুপ্তা (৩০) ও আলিপুরদুয়ারের শামুকতলার খাতোপাড়া গ্রামের হরেকৃষ্ণ দাস। এদিন বিকেলে হড়পা বানে আচমকাই জল বাড়তে শুরু করে নদীতে। জল বেড়ে যাওয়ায় প্রাণ বাঁচাতে তাঁরা আশ্রয় নেন নদীর মধ্যে থাকা একটি উঁচু বালির ঢিপিতে। ক্রমশ বাড়তে থাকে নদীর জল। চারদিকে শুধু ঘোলাটে জল। মাঝে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত একটু উঁচু স্থানে তাঁরা।
এদিকে সময় যত গড়াচ্ছে জলও তত বাড়ছে। নদীতে আচমকাই জল বাড়ার খবর ছড়িয়ে পড়তেই নদীর পাড়ে ভিড় জমান স্থানীয়রা। সেই সময়ই স্থানীয়দের নজরে আসে যে প্রাণ হাতে নদীতে দাঁড়িয়ে আছে তিন শ্রমিক। এরপরেই স্থানীয়রা শুরু করে দেন নিজেদের মত করে তাঁদের উদ্ধারের মরীয়া প্রচেষ্টা। কেউ পাড় থেকে তাঁদের দিকে দড়ি ছুড়ে দেন। যদিও তা ৩ শ্রমিক পর্যন্ত পৌঁছনো তো দূরের কথা, জলের ঘূর্ণিতে পাক খেয়ে আবার পাড়েই ফেরত চলে আসতে থাকে। কেউ আবার নদীতে নামার চেষ্টা করলেও সেই প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়। দ্রুত খবর যায় ব্লক প্রশাসন ও পুলিশের কাছে। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে আসেন বিডিও পঙ্কজ কোণার, ব্লক প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলা আধিকারিক রণিত বিশ্বাস, নাগরাকাটা থানার আইসি কৌশিক কর্মকার সহ আরও অনেকে। একটি আর্থ মুভার নামিয়ে শুরু হয় অপারেশন গাঠিয়া। টানা ২০ মিনিটের লড়াইয়ের পর ৩ জনকে উদ্ধার করতে সমর্থ হন উদ্ধারকারীরা। তিন শ্রমিককে নদী থেকে উদ্ধার করে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে আসার পর ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে উদ্ধারকারী থেকে প্রশাসনের কর্তাদের।
আরও পড়ুনঃ উত্তরবঙ্গে নতুন ‘বিপদ’, উধাও ২০ লক্ষ টাকা; রাত হলেই বেরিয়ে পড়ছে গ্যাস কাটার নিয়ে
এদিন বিডিও পঙ্কজ কোণার বলেন, “নদীর যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় তাতে যখন তখন যা কিছু ঘটে যেতে পারত। পাইপ লাইন ফেটে যেতে পারে এই আশঙ্কায় আর্থ মুভারও নামতে চাইছিল না। পাইপের কোন ক্ষতি হলে সেই খরচ আমরা দেব এমন আশ্বাস দিলে কাজ শুরু হয়। তখন মাথাতে একটাই কথা ঘুরছিল ওঁদের যেভাবেই হোক বাঁচাতে হবে।”
উল্লেখ্য, ২০২২ সালের ২৯ মে এই গাঠিয়া নদীতেই হড়পা বানের কবলে পড়ে গাঠিয়া বাগানের এক সিনিয়ার ফ্যাক্টরি অ্যাসিট্যান্ট ম্যানেজারের স্ত্রী ও কন্যার মৃত্যু পর্যন্ত হয়েছিল। মোহন, যোগেশ বা রাজকুমারদের নদীর চরিত্র নিয়ে বেশি কিছু জানা ছিল না। রাজকুমার বলছেন, “কাজে মগ্ন ছিলাম। নদীতে তেমন জলও ছিল না। হঠাত দেখি হু হু করে কাঁদা মাখা ঘোলা জল নেমে আসছে। কিছু ভাবার আগেই আমরা জলবন্দী হয়ে পড়ি। ভাগ্যিস ওই উঁচু স্থানটাতেই ছিলাম। নয়ত যে কি হত একমাত্র ইশ্বরই জানেন। বাড়ির সবার মুখগুলি খুব মনে পড়ছিল।”
সংশ্লিষ্ট সূত্রেই জানা গিয়েছে, এদিন একসঙ্গে ৫ শ্রমিক নদীবক্ষে পাইপ লাইনের কাজ করছিলেন। তাঁদের মধ্যে মুকেশ গুপ্ত ও রাজেশ কুমার নামে বিহারেরই দুই শ্রমিক হড়পা আসার আগেই পাড়ে চলে গিয়েছিলেন। আর কয়েক মিনিটের মধ্যে যাওয়ার কথা ছিল ওই ৩ জনেরও। তাঁর আগেই নদী উত্তাল হয়ে ওঠে। অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে থাকেন তাঁরা। প্রশাসনের কর্তারা এসে তেল কোম্পানীর হয়ে কাজে আসা সংশ্লিষ্ট এজেন্সীর আর্থ মুভারকে দ্রুত নামতে বলেন। এর পরের কাহিনী যেন ঠিক সিনেমার শেষ দৃশ্যের ক্লাইমেক্স।
আর্থ মুভার চালক জ্ঞানেন্দ্র সিং নদীতে নেমেও বড় পাথরের কারণে ওই ৩ জনের একদম কাছে পৌঁছতে পারেননি। তখনও প্রায় ১০ ফুটের ব্যবধান। এরপর যন্ত্রের সামনের অংশ ঘুরিয়ে দিলে অন্য পাড় থেকে আর্থ মুভারের ডালায় বসে সামনে আসেন অমিত গুপ্তা নামে আরেক শ্রমিক। তিনি এসে নাইলনের শক্ত দড়ি ছুঁড়ে দিলে একে একে ৩ জন ডালাতে এসে বসেন। এককথায় ফিরে পান দ্বিতীয় জীবনও।
তাঁদের যথন নদীর পাড়ে এনে নামিয়ে দেওয়া হয় তখন জনতার যেন বাঁধভাঙা যুদ্ধ জয়ের উল্লাস। ভিড়ের মধ্যে থেকে থানায় প্রথম এই দূর্বিপাকের খবর জানানো গ্রাসমোড় চা বাগানের অমিত পাশোয়ান নামে এক যুবক বলে ওঠেন, “আমি জানতাম রাখে হরি তো মারে কে।”