৫ অগস্ট ২০২৪; গণঅভ্যুত্থানের মুখে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। সরকারি চাকরিকে কোটা বিরোধী ব্যবস্থার অবসান চেয়ে শুরু হওয়া বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন শেষ পর্যন্ত হাসিনা সরকারের পতনের এক দফা অভিযানে পরিণত হয়েছিল। আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল গত বছর ১ জুলাই।
বাংলাদেশের একাধিক সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে, জুলাই-অগস্ট বিপ্লবের বর্ষপূর্তিতে আরও একটি অভ্যুত্থান সংঘঠিত হতে পারে সে দেশে। সেই অভ্যুত্থানের লক্ষ্য রাষ্ট্রপতি মহম্মদ সাহাবুদ্দিনকে অপসারণ।
বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানে রাষ্ট্রপতি নিজে সরে না গেলে তাঁকে অপসারণের কোনও সুযোগ নেই। নয়া অভ্যুত্থানের উদ্দেশ্য হবে বাষ্ট্রপতি ভবন তথা বঙ্গভবন ঘিরে এমন পরিস্থিতি তৈরি করা যাতে মহম্মদ সাহাবুদ্দিন চুপ্পু পদত্যাগে বাধ্য হন। তিনি স্বেচ্ছায় সেই পথে না হাঁটলে সরকার নিরাপত্তা এবং আইনশৃঙ্খলার দোহাই দিয়ে তাঁকে সরে যেতে চাপ দিতে পারে। বাংলাদেশে সরকারের চাপে রাষ্ট্রপতির মেয়াদ শেষের আগে সরে যাওয়ার একাধিক নজির আছে।
আরও পড়ুন: ‘ওকেই চাই…’, পাঁচতারা হোটেলে যৌন হেনস্তা শিক্ষিকার
হাসিনাকে হটানো অভ্যুত্থানকারী ছাত্র নেতৃত্বের এক প্রথমসারির নেতা ‘দ্য ওয়াল’-কে বলেছেন, জুলাই-অগস্ট গণবিপ্লবের বর্ষপূর্তিতে এভাবেই উদযাপনের পরিকল্পনা নিয়ে এগচ্ছেন তাঁরা। লক্ষ্য রাষ্ট্রপতির অপসারণ। তাঁর কথায়, বর্তমান রাষ্ট্রপতি হাসিনা সরকারের মনোনীত। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত তিনি। হাসিনার ফ্যাসিবাদী সাম্রাজ্যের প্রতিনিধি তিনি। তাঁকে সরিয়ে অভ্যুত্থানের অসম্পূর্ণ কাজ পূর্ণ করা হবে।
গত বছরই সেই চেষ্টা দু’বার হয়েছে। একবার মাঝরাতে রাষ্ট্রপতি ভবন ঘেরাও করেছিল ছাত্র জনতা। গেট ভেঙে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করে। লাঠি-গ্যাস চালিয়ে তাদের থামানো হয়। দ্বিতীয় চেষ্টা হয়েছিল গত ২১ ফেব্রুয়ারি। সেদিন রাতে রাষ্ট্রপতি প্রথা মেমে ঢাকার শহিদ মিনারে ভাষা শহিদদের শ্রদ্ধা জানাতে গেলে তাঁকে সেখানেই ঘেরাও করার ছক কষেছিল একাধিক গোষ্ঠী। পরিস্থিতি এমন দিকে গড়ায় যে গোয়েন্দা এবং নিরাপত্তা রক্ষীদের পরামর্শে রাষ্ট্রপতিকে তৈরি হয়েও দীর্ঘ সময় বঙ্গভবনে অপেক্ষা করতে হয়। নিরাপত্তার বহন বাড়িয়ে রাষ্ট্রপতির শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের ব্যবস্থা করা হয়।
বাংলাদেশের রাজনীতির নিবিড় পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন আর একটি ৫ অগস্ট সংঘঠিত করার লক্ষ্যেই বুধবার বন্দর নগরী চট্টগ্রাম দিনভর অচল করে রাখে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতা। এক রাজনৈতিক বিশ্লেষক চট্টগ্রামের ঘটনাকে ‘তাওয়া গরম’ বলে উল্লেখ করে বলেন, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক পার্টিকে সক্রিয় করতেই চট্টগ্রামে ছাত্র-জনতার গা গরমের রাস্তা অবরোধের কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল। বঙ্গভবন ঘেরাওয়ের আগে এই ধরনের অববোধ আন্দোলন আরও হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
পাশাপাশি একই লক্ষ্যে বুধবার বিনা নোটিসে তড়িঘড়ি বাংলাদেশ অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলায় ছয় মাসের কারাবাসের সাজা ঘোষণা করেছে, মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। হাসিনা সরকারের পতনের বর্ষপূর্তির আগেই সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সাজা ঘোষণা করে হতাশ ছাত্র-জনতাকে চাগানোর চেষ্টা হল বলে মনে করছে রাজনৈতি মহল। আওয়ামী লিগ আদালতের রায়কে অবৈধ, বেআইনি বলে মন্তব্য করেছে।
আরও এক অভ্যুত্থানের সম্ভাবনা প্রকট হয়ে উঠেছে জুলাই ঘোষণাকে কেন্দ্র করে। জুলাই মাসেই ছাত্র-জনতার দাবি মতো জুলাই ঘোষণাপত্র জারি করার কথা ইউনুস সরকারের। কিন্তু মঙ্গলবার জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ঘোষণা করেছেন, সরকার নয়, তারাই জুলাই ঘোষণাপত্র জারি করবেন। তাতে বর্তমান সংবিধান বাতিল এবং গণপরিষদের নির্বাচনের কথা বলা হবে।
ঘটনা হল, চালু সংবিধান বাতিল হলে চুপ্পুর রাষ্ট্রপতি থাকা কঠিন। একইভাবে অন্তর্বর্তী সরকারকেও পুনর্গঠন করতে হবে। বুধবার ‘বঙ্গবার্তা’-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের বিশিষ্ট কবি, প্রাবন্ধিক, চিন্তক তথা হাসিনা সরকারের পতনের কারিগরদের মুখ্য পরামর্শদাতা ফরহাদ মজহার বলেছেন, ৫ অগস্টের অভ্যুত্থানের লক্ষ্য শুধু কোটা ব্যবস্থার অবসান ছিল না। সামগ্রিক ব্যবস্থার পরিবর্তন চেয়েছিল মানুষ। বর্তমান সংবিধান এবং সেটির আধারে তৈরি পদ ও প্রতিষ্ঠান বহাল রেখে ব্যবস্থার বদল সম্ভব নয়। অসম্ভব ফ্যাসিবাদের অবসানও। তাঁর কথায় আগামী দিনগুলিতে রাজনীতি কোন খাতে বইবে বলা কঠিন। অনেক কিছুই হতে পারে যা ভাবা হয়নি।
আরও পড়ুন: অভিজিৎ সরকার খুনে সিবিআইয়ের সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট, চাঞ্চল্য রাজনৈতিক মহলে
চাপের মুখে চুপ্পু সরে গেলে পরবর্তী রাষ্ট্রপতি কে হতে পারেন? নতুন করে কোনও সরকার গঠিত হবে কি? এসব প্রশ্ন সামনে আসতে শুরু করেছে। এক ছাত্র নেতার কথায়, দুটি ভিন্ন বিষয়। পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত হবে। গত বছর ৩ অগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের ডাক দেওয়ার সময় পরবর্তী সরকারের চরিত্র, আকার নিয়ে ভাবা হয়নি।
প্রসঙ্গত, হাসিনা সরকারের পতনের সময় বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনও বিধান ছিল না। শেখ হাসিনার সরকার সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করে দিয়েছিল। যদিও আওয়ামী লিগ-সহ বিরোধী দলগুলির লাগাতার আন্দোলনের মুখে বিএনপি পরিচালিত খালেদা জিয়ার সরকার নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংবিধানে যুক্ত করেছিল। আদালতের রায়ে সেই সরকারের বিধান বাতিল হওয়ায় সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শে মহম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গড়তে হয়।
ঘটনাচক্রে বুধবার বাংলাদেশের ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে সবদল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান ফেরানোর প্রস্তাবে সহমত হয় বলে কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান আলি রিয়াজ জানিয়েছেন। ফলে পরবর্তী জাতীয় সরকার গঠনের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে এনে বিএনপি তাদের রাজনৈতিক জয় হাসিল করার চেষ্টা করতে পারে। হাসিনার সময়ে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি ছিল খালেদা জিয়ার পার্টির প্রধান ইস্যু।
ইউনুস সরকারের বিগত সাড়ে সরকার নিয়ে দুটি বিষয় সামনে এসেছে। এক. হাইকোর্টের রায়ে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান আবার সংবিধানে ফেরানোর সুযোগ এসেছে। দুই. অম্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শমূলক নোটে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সই করেছিলেন কি না তা নিয়ে সংশয়, সন্দেহ দেখা দিয়েছে। ফলে আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবর্তে নতুন একটি সরকার গঠন জরুরি হয়ে পড়েছে বলে সংশ্লিষ্ট মহল মনে করছে। সেক্ষেত্রে বিএনপি আস্থাভাজন কাউতে প্রধান উপদেষ্টা করে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গড়ার সুযোগ নিতে পারে। সেক্ষেত্রে মহম্মদ ইউনুস হয়ে যেতে পারেন মনোনীত রাষ্ট্রপতি। নতুন সংসদ গঠনের পর নতুন করে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করা হবে। কারও কারও মতে, এই সুযোগে ইউনুস সরে গিয়ে খালেদা জিয়া রাষ্ট্রপতি হয়ে যেতে পারেন।
তবে সবটাই নির্ভর করছে মহম্মদ সাবাবুদ্দিন চুপ্পুকে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে সরানো সম্ভব হবে কি না তার উপর। চুপ্পুকে সরাতে ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে সরকার তথা সেনা বাহিনী কতদূর এগতে দেবে তার উপর পরবর্তী অধ্যায় নির্ভর করছে। একাধিক সূত্র জানাচ্ছে, রাষ্ট্রপতির গদি বাঁচাতে সেনাপ্রধান আগের মতো আর বাধা হবেন না বলেই মনে করা হচ্ছে। সেনা প্রধান ওয়াকার উজ জামান হম্বিতম্বি কমিয়ে সরকারের সঙ্গে বোঝাপড়া করে নিয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। আগের মতো অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের কথা তাঁর মুখে শোনা যাচ্ছে না। মব তৈরি করে হত্যা, মারধর, ভাঙচুরের ঘটনা ফিরে এলেও সেনাপ্রধান চুপ। জানা যাচ্ছে মহম্মদ ইউনুসের পাশাপাশি সেনাপ্রধান ওয়াকারও বিএনপি সুপ্রিমো খালেদা জিয়ার আস্থাভাজনের তালিকায় নাম তুলে নিয়েছেন। ফলে রাষ্ট্রপতি সরে গেলে সেনাপ্রধানের গদি যাওয়ার আশঙ্কা থেকে মুক্ত ওয়াকার।