“নীরব পৃথিবী চায়” (Part:7)
সৌমেন মুখোপাধ্যায়
বাজারের থলিটা রান্নাঘরে সুনিতার সামনে রেখে সেখানেই বসে পড়ে নরেন। বড়ভায়ের মুখ দেখতে না পেলেও বেশ অনুমান করে সুনিতা বলে, “কি হলো দাদা, তুমি অমন করে এখানে বসে দিলে ?”
“কই কিছু নাতো। আসলে কালকে অনেক পরিশ্রম হয়েছিল কিনা তাই। ”
“ডাক্তারখানা গিয়েছিলে?”
“ডাক্তারখানা” শব্দটা শুনে নরেন আরো রেগে যায়, ভাবতে থাকে ডাক্তারের ফিসের কথা, যে ডাক্তার রোগী না দেখে ফিস নিতে চায় সে কেমন ডাক্তার। কোনরকমে রাগটা কমিয়ে বলে, “হাঁ, গিয়েছিলাম। ”
“কি বললেন ডাক্তারবাবু ?”
“কিছু না, শুধু ফিস চাইলেন। অতক্ষণ বসে বসে তার সময় নষ্ট করেছিলাম তার ফিস চাইছিল।” কথাটা বলে নিজের রাগ সামলাতে না পেরে সেখান থেকে উঠে নরেন বাইরে বেরিয়ে যায়।
খানিকক্ষণ বাদে আবার নরেন বাড়ী ফিরে আসে কিন্তু ঘরে ঢুকতেই থমকে দাঁড়ায়। বাড়ীর মালিকের পা ধরে চঞ্চলাদেবী কাঁদছেন। আর চিৎকার করে বললেন, “আর ক’টা দিন অপেক্ষা করুন, আর ক’টা দিন। ছেলেটার চাকরী হয়ে গেলে আমি সব টাকা সুদে- আসলে শোধ করে দেব। ” কথাটা বলে বেশ কিছুক্ষণ হাঁফাতে থাকেন আর কাশতে থাকেন।
“না না, সে কথা শুনব না, আমার আজকের মধ্যেই টাকাটা লাগবে। নাহলে এই ঘর…….., ভালো করে ভেবে দেখো। কখন রাম রাজা হবে আমি সেই অপেক্ষায় বসে থাকবো কি ? না, আমার আজকের মধ্যেই টাকা লাগবে। অ্যা, এই বলে রাখলাম। পা ছাড়ো।” কোনরকমে জোর করে পাগুলো ছাড়িয়ে চোখের চশমা নাকের ডগায় এনে হাতের ছাতা বগলে গুঁজে হিসাবের খাতা বার করে বলতে থাকেন। “দেখো, এইমাস পর্যন্ত হয়েছে সাতশ সত্তর টাকা আর সুদ হয়েছে দু’শো কুড়ি টাকা। সবসমেত নয় শত নব্বই টাকা। মানে দশ টাকা এক হাজার টাকা। এই এক হাজার টাকা তো আর একটুখানি নয় যে যখন তখন বার করে দেবে। ভালো চাও তো এই জায়গা ছেড়ে চলে যাও এখানে নতুন ভাড়াটে বসাব। কি হলো চুপ করে রইলে যে।”
“চক্রবর্তীমশায়, কি হয়েছে ?” এবার নরেন হুংকার দিয়ে বলে।
“না না, কিছু হয়নি। এই তোমার মায়ের সাথে বাড়ী ছাড়াবার কথা হচ্ছিল। দেখো না দেখো, তুমি তো লেখাপড়া জানো, এই হিসাবপত্রটা একবার দেখে নাও। নয়শত নব্বই টাকা না তার কম। আমি তো মিথ্যা কথা বললে তো এই খাতা তো মিথ্যা কথা বলবে না। গতবার ছেড়ে দিয়েছি, এবার টাকা নিয়ে যাবো নাহলে ঘর নিয়ে যাবো। অ্যা, এই বলে রাখলাম। ” ধুতির কাছাটা বেশ ভালো করে গুঁজে বগলে ছাতাটা মাটিতে নামিয়ে ঠুকতে থাকেন।
হিসাবের খাতা দেখে নরেনের এবার মাথায় বজ্রাঘাত পড়ল। কি করে মা চক্রবর্তীমশায়ের কাছে এতগুলো টাকা ধার করেছিলেন……. । মায়ের দিকে একবার তাকায় নরেন। মা লজ্জায় মাথা নীচু করে বসে আছেন আর বোন সুনিতা রান্নাঘরের একটা দরজার পাল্লাকে ভর করে দাঁড়িয়ে আছে। রান্নার দিকে কারুর আজ মন নেই। সবার মুখ আজ ফ্যাকাসে শুধু শকুনি চক্রবর্তীমশায়ের মুখ ছাড়া, তিনি শুধু হাঃ হাঃ হাঃ করে হাসছেন।
মিথ্যা, সব মিথ্যা। এতদিনের পরিশ্রম আজ তার কাছে মিথ্যায় পর্যবসিত হয়েছে। শিক্ষিত হতে গিয়ে পড়াশুনা করতে গিয়ে মায়ের অনেক টাকা আজ নরেন জলে দিয়েছে। তিনবছর বেকারের মতো প্রত্যেকের দরজায় দরজায় ঘুরেছে- কিন্তু বৃথা চেষ্টা।
“চক্রবর্তীমশায়, আর দিনকয়েক অপেক্ষা করুন, আপনার সমস্ত টাকা আমি নিজে ঠিক শোধ করে দেবো, কথা দিচ্ছি।”
“কখন ? চাকরী করে না চুরি – ডাকাতি করে ?” কথাটা শুনে নরেন নিরুত্তর। কোন কথা আজ তার মুখে জোগাচ্ছে না, জিহ্বা শুকিয়ে গেছে।
“হাঃ হাঃ হাঃ, তাহলে আমি আসি।” দরজার কাছে গিয়ে আবার বলেন, “টাকা না পেলে ঘরটা কিন্তু আমার হয়ে যাবে। হেঃ হেঃ হেঃ।”
চক্রবর্তীমশায় চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে নরেন। এখন কি করবে কিছুই বুঝতে পারে না। বন্ধুমহলের মধ্যে কেই বা তাকে সমস্ত টাকা ধার দিবে আর কেই বা তার পাশে এসে দাঁড়াবে নরেন সেই কথা ভাবতে থাকে।