সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ জঙ্গল শুধু বাঘ, নদী আর গরান-গেওয়ার নয়-এই অরণ্যের প্রতিটি কোণে মিশে আছে বিশ্বাস, ভক্তি আর লোকগাথার এক দীর্ঘ ইতিহাস। দক্ষিণ রায়ের পাশাপাশি এখানকার মানুষ আজও পুজো করেন বনবিবির। বিশ্বাস, তিনি-ই দক্ষিণ রায়ের ক্রোধ থেকে রক্ষা করেন সুন্দরবনবাসীকে, জেলে-মৌয়ালদেরও।
আরও পড়ুনঃ জগতের সমস্ত শক্তির উৎস; দেবী জগদ্ধাত্রী
লোকমুখে প্রচলিত, বনবিবির কাহিনি শতাব্দী প্রাচীন। সুন্দরবন ব্যাঘ্রসঙ্কুল অঞ্চল বলেই দক্ষিণ রায়কে এখানে বাঘরূপে পুজো করা হয়। কথিত আছে, যশোরের ব্রাহ্মণনগরের রাজা মুকুট রায়ের অধীনে ছিলেন দক্ষিণ রায়। কোথাও আবার তাঁকে দেবতার রূপেও দেখা যায়। তবে ভাটির দেশে বনবিবি দেবীর আদলেই তাঁর পুজো প্রচলিত।
এক পুরোনো লোককথা বলছে- সুন্দরবনের এক প্রত্যন্ত গ্রামে এক বিধবা মহিলা ও তাঁর ছোট ছেলে দুখে বাস করত। বাপহারা দুখের দুই কাকা ধনা ও মনা একদিন তাকে নিয়ে যায় মধু সংগ্রহে। যাওয়ার আগে মা সতর্ক করে দেন, ‘বিপদে পড়লে বনের আরেক মা—বনবিবিকে স্মরণ করিস, তিনিই তোর রক্ষা করবেন।’ বনে তখন রাজত্ব দক্ষিণ রায় ও গাজি আউলিয়ার। গাজি ছিলেন সাধুপ্রকৃতির, কিন্তু দক্ষিণ রায় ছিলেন অহংকারী ও দাপুটে বাঘরূপী দেবতা। এই দুই দেবতার মধ্যে ছিল গভীর বন্ধুত্ব।
এক রাতে দক্ষিণ রায় স্বপ্নে এসে ধনা ও মনাকে আশীর্বাদ দেন মধু ও ধনসম্পদে সমৃদ্ধ হওয়ার জন্য, তবে শর্ত রাখেন, দুখেকে তাঁকে উৎসর্গ করতে হবে, না হলে নৌকা ডুবিয়ে দেবেন। লোভে পড়ে কাকা-দুজন রাজি হয়ে যায়। পরদিনই তারা দুখেকে ছল করে এক নির্জন দ্বীপে ফেলে আসে।
আরও পড়ুনঃ দেবী হৈমন্তিকার জন্ম হল কৃষ্ণনগরে, দাপট চন্দননগরে! কিন্তু কেন?
একলা দুখে যখন বুঝতে পারে, তাকে বলি দেওয়া হয়েছে, তখনই মনে পড়ে মায়ের কথা, ‘বিপদে বনের মাকে ডাকবি।’ কাঁদতে কাঁদতে সে বনবিবিকে স্মরণ করে। আর ঠিক তখনই এক দীপ্তিময় দেবী এসে দাঁড়ান তার সামনে, এক হাতে খোলা তলোয়ার, অপরূপ রূপ।
দুখের মুখে ঘটনার বর্ণনা শুনে বনবিবি ক্রোধে ফেটে পড়েন। সঙ্গে সঙ্গে ভাই শাহ জঙ্গলীকে আদেশ দেন রণসাজে সজ্জিত হতে। শাহ জঙ্গলী অল্প সময়েই দক্ষিণ রায় ও গাজি আউলিয়াকে বনবিবির সামনে এনে হাজির করেন। বনবিবির সামনে পরাস্ত হয়ে দক্ষিণ রায় অবশেষে তাঁর বশ্যতা স্বীকার করেন।
এই কারণেই আজও বনবিবির মূর্তির পাশে থাকে এক ছোট ছেলের প্রতিমা, সেই দুখে। সেই বাপহারা শিশুটির মতোই সুন্দরবনের প্রতিটি জীবজন্তু ও মানুষের রক্ষক বলে মানা হয় বনবিবিকে।
সুন্দরবনের বহু অঞ্চলে আজও বনবিবি, শাহ জঙ্গলী ও দক্ষিণ রায়ের একত্রে পুজো হয়। কোথাও তাঁরা মানুষরূপে, কোথাও বা বাঘরূপে আরাধ্য। দুখের উপস্থিতি ও শাহ জঙ্গলীর যুদ্ধরূপ আজও স্মরণ করিয়ে দেয় সেই গাঁথাকে—যেখানে বিশ্বাসই শেষ পর্যন্ত জিতেছিল ভয়কে।





