কুশল দাশগুপ্ত, শিলিগুড়ি:
সুখী গৃহকোণ ঠিক কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে একমত হওয়া কঠিন। কিন্তু চব্বিশ ঘণ্টা জল, বিদ্যুৎ, নিরাপত্তা – রক্ষী, অফুরন্ত পার্কিং, জিম, ইনডোর গেমস এবং সঙ্গে যদি মেলে ফ্রি ওয়াইফাই জোন তাহলে তো কথাই ও নেই। এমনকী, জরুরি প্রয়োজনে তালা ন না-দিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেও চিন্তা নেই। ফিরে দেখলেন, বাড়ির পোষা টিয়াকে জল আর মটর দানা খাইয়ে গিয়েছেন প্রতিবেশী। অথবা লাগোয়া ফ্ল্যাটে প্রতিবেশীর ঘরে আরামে নিদ্রা যাচ্ছে আপনার দুধের শিশু। অনেকে ভাববেন, একসঙ্গে এতকিছু আদৌ পাওয়া কি সম্ভব? শিলিগুড়ির পাঞ্জাবিপাড়ার ভগবতী অ্যাপার্টমেন্টে সবই সম্ভব।
২০০৫ সালে ১১২টি ফ্ল্যাট নিয়ে পাঞ্জাবিপাড়ায় যখন এই অ্যাপার্টমেন্টটি তৈরি হয় তখন আবাসিকরা কেউই ভাবেননি যে জীবন এত সুন্দর হতে পারে। কমিউনিটি হল। পার্টি হল। সারা বছর তিথি নক্ষত্র মেনে নানা উৎসব। রাত ন’টার পরে গ্রাউন্ড ফ্লোরে সকলে মিলে আড্ডা। বয়স্কদের আলাদা দল। ছোটদের আলাদা গ্রুপ। মহিলাদের আলাদা টিম। রাতের খাবার চলে আসছে আড্ডাস্থলেই।
আরও পড়ুন: শিলিগুড়িতে জলের হাহাকার; দিশেহারা মানুষ
ফ্ল্যাট যেন তখন স্রেফ ঘুমোতে যাওয়ার একটা জায়গা। শুরু থেকে পরিষেবা একই রকম থাকলেও করোনার সময়ে ভগবতী আবাসনের পরিবেশটাই পুরোপুরি বদলে যায়। নিজেদের ঘরবন্দি করে নেওয়ার বদলে আবাসিকরা নেমে আসেন গ্রাউন্ড ফ্লোরে। ঠিক হয়, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না-হওয়া পর্যন্ত কেউ আবাসনের বাইরে যাবেন না। বাইরের কাউকে আবাসনে ঢুকতে দেওয়া হবে না। কারও ঘরে রান্না হবে না। নীচে গ্রাউন্ড ফ্লোরে চালু করা হয় কমন কিচেন।
কোনও দিন ছেলেরা রান্না করছেন তো কোনও দিন মেয়েরা। ভগবতী অ্যাপার্টমেন্টের সভাপতি পেশায় আইনজীবী অত্রি শর্মা বলেন, ‘করোনা গোটা দেশের মানুষকে পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিলেও আমাদের আবাসিকদের যেন এক সুরে বেঁধে দিয়েছে। এখানে মতান্তর থাকতে পারে। তবে মন কষাকষি নেই।’
ভগবতী অ্যাপার্টমেন্টটাই যেন একটা মিনি ভারতবর্ষ। সমস্ত ভাষাভাষির মানুষ এখানে বাস করেন। শিক্ষকতা সূত্রে দীর্ঘদিন কালিম্পংয়ে কাটিয়ে দেওয়া দীপ্তিরানি দীক্ষিত যেমন। আদতে বাঙালি। অবাঙালিকে বিয়ে করেন। ২০১৭ সালে চলে আসেন ভগবতী অ্যাপার্টমেন্টে। তিনি এখানকার বয়স্কা মহিলাদের লিডার। আবাসনের সম্পাদক নরেন্দ্র আগরওয়াল, পেশায় ব্যবসায়ী। সারাদিন ব্যস্ত থাকেন। তার মধ্যেও সময় পেলেই বসে পড়েন আবাসনটির বাসিন্দাদের আর কী কী পরিষেবা দেওয়া যেতে পারে, তার হিসেব কষতে। আর এক ব্যবসায়ী নির্মল আগরওয়াল। সারাদিন তিনিও ব্যস্ত। আবাসনের তিনিই ছিলেন প্রথম সভাপতি।
আরও পড়ুন: কারণ নিয়ে ধোঁয়াশা! সন্তানকে ‘মেরে’ আত্মহত্যার চেষ্টা মায়ের
এখনও সময় পেলেই বসে পড়েন আবাসিকদের সঙ্গে আড্ডায়। আবাসিক যুগরাজ সরোজিয়া বলেন, ‘এখানে সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, দরজায় তালা দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। প্রতিবেশীরাই আমাদের সকলের ফ্ল্যাটের পাহারাদার।’ দীপ্তিরানি দীক্ষিতের মেয়ে উমা দাস। মায়ের দেখভালের প্রয়োজনে এই আবাসনে থাকেন। উমা দেবী বলেন, ‘এই আবাসন যেন একটা মন ভালো রাখার জায়গা। এখানে মানসিক অবসাদে ভোগার কোনও সুযোগ নেই। আবাসিকদের সঙ্গে কেটে যায়।’
সারা বছর আবাসনে উৎসব লেগেই থাকে। স্বাধীনতা দিবস থেকে প্রজাতন্ত্র, ছট পুজো থেকে দীপাবলী, গীতা পাঠ চলছেই। উৎসবের সংগৃহীত টাকা আবার জনসেবার কাজে ব্যবহার করা হয়।