সৌমেন মুখার্জ্জী, বাঁকুড়া:
শুরুটা হয়েছিল মল্লরাজাদের আমলে। শারদোৎসব মিটতেই শতাব্দী প্রাচীন সেই রাবণকাটা উৎসব ঘিরে আজও সরগরম হয়ে ওঠে মন্দিরনগরী বিষ্ণুপুর। এই উৎসবের অন্যতম অঙ্গ হলো রাবণকাটা নৃত্য। প্রতি বছর দুর্গাপুজোর শেষ পর্বে দশমী থেকে দ্বাদশী পর্যন্ত এই উৎসবের স্বাদ চেটেপুটে উপভোগ করেন বিষ্ণুপুরবাসী। সেই উন্মাদনা রয়েছে এ বারও।
আরও পড়ুনঃ অবিলম্বে গাজ়ায় হামলা বন্ধ করুন, ইজ়রায়েলকে নির্দেশ ট্রাম্পের
ইতিহাস বলছে, বিশেষ এই লোকসংস্কৃতি একসময়ে মল্লরাজাদের বিনোদনের অন্যতম অঙ্গ ছিল। এখন জৌলুস ফিকে হলেও প্রাচীন এই ঐতিহ্যকে বংশপরম্পরায় কোনও রকমে টিকিয়ে রেখেছেন সুকুমার, নারাণ, মিঠুন, রঞ্জিতদের মতো শিল্পীরা। ওঁরা পেশায় দিনমজুর। তবে এই উৎসবকালে তিন দিন ওঁরাই ‘সেলেব’ (সেলিব্রিটি) হয়ে যান মল্লভূমে।
হনুমান, জাম্বুবান, সুগ্রীব আর বিভীষণ সেজে বাজনার তালে পরিবেশন করেন রাবণকাটা নৃত্য। উস্কে দেন মল্লরাজাদের স্মৃতি। রাবণকাটা উৎসবের সুচনা হয় দশমীতে। ওই দিন প্রথম রাতে বিষ্ণুপুরে রঘুনাথ জিউ মন্দিরের সামনে হয় মেঘনাদবধ। পরের দিন একাদশীর রাতে কুম্ভকর্ণবধ। আর দ্বাদশীতে শেষ রাতে হয় রাবণবধ। সেই রাবণবধকে ঘিরেই একাদশী ও দ্বাদশী দু’দিন শহরের পাড়ায় পাড়ায় রাবণকাটা নৃত্য পরিবেশন করেন কুশীলবরা, যা উপভোগ করার জন্য বছরভর অপেক্ষায় থাকেন বিষ্ণুপুরবাসী।
হনুমান, জাম্বুবান, সুগ্রীব, বিভীষণ সেজে নাকাড়া, টিকারা, কাঁশির তালে দুয়ারে দুয়ারে নেচে ফেরার পোশাকি নামই হলো রাবণকাটা নৃত্য। মোট আট জনের দল। তাঁদের চার জন নৃত্যশিল্পী। বংশপরম্পরায় হনুমান সাজেন সুকুমার অধিকারী, জাম্বুবান সাজেন নারাণ বারিক, সুগ্রীব সাজেন মিঠুন লোহার আর বিভীষণ সাজেন রঞ্জিত গড়াই। নাকাড়া, টিকারা ও কাঁশি, এই তিন বাদ্যযন্ত্র নিয়ে নাচে সঙ্গত দেন সনাতন ধাড়া, শ্যামাপদ পণ্ডিত, তারাপদ ধাড়া, রঞ্জিত কালিন্দিরা। নৃত্যশিল্পীদের পরনে থাকে পাটের তৈরি লোমশ আলখাল্লা। মাথায় গামার কাঠের মুখোশ। এই বেশ ধারণ করে একাদশী ও দ্বাদশী বিষ্ণুপুরের অলিগলিতে বাজনার তালে নাচ দেখিয়ে মানুষকে আনন্দ দেন শিল্পীরা।
আরও পড়ুনঃ বিরল ঘটনা! নবজাতকের পেটে যমজ ‘সন্তান’!
মানুষজন খুশি হয়ে যে যেমন পারেন, অর্থ দেন খুশি হয়ে। দ্বাদশীর রাতে রাবণকাটা দেখার জন্য ভিড় উপচে পড়ে রঘুনাথ জিউ মন্দিরের সামনে। সেখানে মাটির তৈরি বিশাল রাবণের মাথায় পরানো থাকে গামার কাঠের মুখোশ। সেই মূর্তির সামনে বাজনার তালে তালে নৃত্য করতে থাকেন শিল্পীরা। তার পরে একসময়ে তলোয়ার দিয়ে রাবণের মুণ্ডচ্ছেদ করেন বীর হনুমান। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে লঙ্কেশ্বরের দেহ।
কুশীলব দলের সদস্য সনাতন ধাড়া, সুকুমার অধিকারীরা বললেন, ‘এটা শতাব্দী প্রাচীন একটা লোকশিল্প। আমরা বংশপরম্পরায় মল্লভূমের এই প্রাচীন ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছি।’ বিষ্ণুপুর রাজপরিবারের বর্তমান সদস্য জ্যোতিপ্রসাদ সিংহ ঠাকুর বললেন, ‘মল্লরাজাদের পূর্বপুরুষরা এসেছিলেন রাজস্থান থেকে। সেখানকার দশেরার রাবণবধের সঙ্গে মল্লভূমের আঞ্চলিক সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটানোর লক্ষ্যেই বিষ্ণুপুরে সুচনা হয়েছিল রাবণকাটা উৎসবের। অতীতের সেই জৌলুস এখন না থাকলেও মল্লভূমের প্রাচীন ঐতিহ্য টিকে রয়েছে শিল্পীদের হাত ধরে।’