কুশল দাশগুপ্ত, শিলিগুড়িঃ
সবে দুর্গাপুজো কেটেছে, ছুটিতে পাহাড় বেড়াতে যাচ্ছেন লোকজন। কেউ বাবা-মাকে নিয়ে শখ পূরণে ব্যস্ত, কেউ বিয়ের পর পুজোর ছুটিতে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার উন্মাদনায় মত্ত। ৪ অক্টোবরের রাত, ভয়াবহ বৃষ্টি, এক লহমায় ভেসে গেল দুধিয়ার লোহার ব্রিজ। জলে তোরে হারিয়ে গেল বিজনবাড়ি সেতু। জাতীয় সড়ক ১০ বন্ধ, আর রাস্তার ওপর দিয়ে বইছে তিস্তা।
কয়েকবছর আগেও তিস্তার এমন ভয়াবহ রূপ উত্তরবঙ্গের লোকজন দেখেছে, কিন্তু এবার আরও ভয়ঙ্কর সঙ্গে একের পর এক বজ্রপাত। বিগত ৫০ বছরে প্রকৃতির এমন রূপ দার্জিলিং জেলার লোকজন অন্তত দেখেননি। লণ্ডভণ্ড পাহাড় দেখল গোটা রাজ্য। সরকার থেকে বাংলার শিল্পী মহল, পাশে দাঁড়িয়েছিল সকলের। ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আবহাওয়া বদলাতে শুরু করে। এখন কেমন আছে আমাদের দার্জিলিংটা? খাদের ধারে দাঁড়ালে কি তিস্তার নীল জল দেখা যাবে, সকলে কি ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার শক্তি পেয়েছে?
আরও পড়ুনঃ ক্যানসারে ভুগছিলেন, চলছিল চিকিৎসাও; প্রয়াত ‘মহাভারত’ এর কর্ণ অভিনেতা পঙ্কজ ধীর
সেই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে দ্য ওয়ালের তরফে যোগাযোগ করা হয়েছিল ভ্রমণপ্রেমী ও শহরের ট্রাভেল এজেন্সির কর্ণধার শ্রয়ণ সেনের সঙ্গে। তিনি বর্তমানে দার্জিলিঙে রয়েছেন। সেখান থেকেই বর্ণনা করলেন সবটা। আদতে কী হচ্ছে সেখানে, জানালেন আমাদের, দিলেন বার্তাও।
উত্তরবঙ্গের কথা শুনলেই একরাশ ভালবাসা আর স্মৃতির কথা উঠে আসে সকলের মুখে। সেই উত্তরবঙ্গই অর্থাৎ পাহাড়ের অধিকাংশ মানুষ ভাল নেই। একাংশ এই বিপর্যয়ের আঘাত কাটিয়ে ওঠার চেষ্টায় আর বাকিরা তাদের পরিস্থিতি দেখে মর্মাহত। যাঁরা ব্যবসা করছেন, তাঁদের অবস্থা খুব ভাল নয়। ক্ষতি শুধু পরিকাঠামোয় নয়, হয়েছে ব্যবসাতেও। বিপর্যয়ের প্রচার এত বেশি হয়েছে, শহুরে মানুষ ভয় পেয়েছেন। পাহাড় ছন্দে ফেরার চেষ্টা করলেও পর্যটকরা অভয় পাচ্ছেন না। একাংশ এখনও পরিকল্পনা বাতিল করছেন, প্রতিদিন ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে। অনুসারী ব্যবসাও তাই সমানভাবে চাপে।
শ্রয়ণ জানালেন, ওপর ওপর ভাল আছে পাহাড়। ভিতরে চাপা কান্নার মতো কিছু একটা আটকে রয়েছে। দুধিয়া বা তাবাকোশির দিকে তিনি যেতে পারেননি কারণ পরিস্থিতি এখনও ততোটা স্বাভাবিক হয়নি। ফলে ওদিকটার কেমন অবস্থা এখন, তা বলা যাচ্ছে না। ক্ষতি যে মারাত্মক হয়েছে। ওইদিকটা এখনও নিজের মতো সেরে উঠছে। এদিকে দার্জিলিং জেলায় ঢোকার চারটে রাস্তার মধ্যে দুটো বন্ধ থাকায় চাপ আছে ট্র্যাফিকে। দুধিয়ার ব্রিজ ভেঙে যাওয়ায় মিরিক দিয়ে দার্জিলিং ঢোকার রাস্তা বন্ধ, আরেকটা সবথেকে জনপ্রিয় রোহিণী রোড, সেটাও বন্ধ। এখনও ঠিকঠাক করার কাজ চলছে।
বর্তমানে তবে দার্জিলিং কেমন আছে, পর্যটকরা যাচ্ছেন কীভাবে? শ্রয়ণ প্রথমে জানান, ১০ নম্বর জাতীয় সড়ক মাঝেমধ্যে খুলছে, বন্ধ হচ্ছে। খোলা রয়েছে শুধু পাঙ্খাবাড়ি আর হিলকার্ট রোড। এই দুই রাস্তা দিয়ে দার্জিলিং ঢোকা যাবে। সকলে আসছেও এভাবেই। তবে, পর্যটক অনেক কমে গেছে এই বিপর্যয়ের প। যেভাবে বিপর্যয়ের প্রচার হয়েছে, সেরে ওঠার প্রচার ততোটা হয়নি ফলে একশ্রেণির পর্যটক সত্যিই ভয় পেয়েছেন এবং পাহাড়ে যেতে চাইছেন না।
তাঁর কথায়, ‘এটা পিক সিসন এই সব জায়গার। কিন্তু কোথায় কী! আমি আজই দেখলাম, সীমানা বাজার বা পশুপতি বাজার খাঁ খাঁ করছে, পর্যটকশূন্য। এতে যাঁরা আসছেন তাঁদের ঘুরতে ভাল লাগছে কিন্তু এটা এই সময়ের চিত্র না, ফলে মন খারাপ হচ্ছে।’
আরও পড়ুনঃ বন্ধ হচ্ছে ‘আবেগে’র Mtv! তরুণ বয়সে আপনিও কি দেখতেন এই চ্যানেল?
বিপর্যয়ের সময় তিনিই দ্য ওয়ালের পাঠকদের অভয় দিয়েছিলেন, পাহাড় যে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে, তা জানিয়েছিলেন। গ্রাউন্ড রিপোর্টও শেয়ার করেছিলেন খানিকটা। বিপর্যয়ের পরের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে তাঁর মনে হয়েছে, এখনও পর্যটকরা পাহাড়ে আসার অভয় পাচ্ছেন না। বলেন, ‘আমার গেস্টরা এই পর্যন্ত কিছু ক্যানসেল করেননি। আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন একটি দল, তাঁদের আমি অভয় দিতে পাহাড় এসেছেন। তবে শুধু আমাকে দিয়ে বিচার করা যাবে না কারণ সমগ্র চিত্র বলছে, বহু মানুষ ক্যানসেল করেছে। আমি যে হোমস্টে-তে আছি, সেখানেই অনেক ক্যানসেল হয়েছে, ওঁরা বলছিলেন। এতে লস তো হচ্ছেই।’
দার্জিলিং জেলায় ক্ষতি এবার সবচেয়ে বেশি, কোথায় গলদ? বর্তমানে দার্জিলিঙে থাকার সুবাদে কাছ থেকে দেখছেন সবটা। প্রশ্নের উত্তরে তাই এই ভ্রমণপিপাসুর সাফ কথা, ওপর ওপর রাস্তাগুলো ভাল কিন্তু অফবিটে ঢোকার রাস্তা খুবই খারাপ। ভিতরের দিকে যেসব রাস্তা আছে, সেদিকে নজরই দেওয়া হয়নি সেভাবে। যার ফলে সুখিয়াপোখড়ি থেকে একটা ছোট্ট রাস্তায় চার জায়গায় ধসের চিহ্ন এখনও বর্তমান।’
তাঁর সঙ্গে কথোপকথনেই জানা যায়, পাহাড়ের একাংশের না কি অভিযোগ, সাময়িক রাস্তা ঠিক করে দেওয়া হচ্ছে প্রশাসনের তরফে, কিন্তু তাতে আবার একটু বৃষ্টি হলেই সেটা ধুয়ে যাচ্ছে। কাল যদি আবার ওমন বৃষ্টি হয় সাধারণ মানুষকে ফের ভুগতে হবে। আর ভুগতে তো হচ্ছেই বার বার। বাইরে থেকে দুঃখে প্রলেপ দেওয়া যায় না তাই এইভাবে ‘ভাল’ থাকার লড়াই তাঁদের। আর সেটা আজ থেকে নয়, চলছে বহু বছর ধরে।
শেষে পর্যটকদের উদ্দেশে শ্রয়ণের একটাই বার্তা, চারটের বদলে দু’টো রাস্তা দিয়ে যাতায়াত চলছে, ফলে ট্র্যাফিক হেভি, সময় নিয়ে বেরতে হবে গন্তব্যের উদ্দেশে, ধৈর্য রাখতে হবে আর খাবার-সহ প্রয়োজনীয় জিনিস হাতের সামনে রাখা ভাল। দার্জিলিং জেলার ক্ষেত্রে এটুকু মানলেই ভ্রমণে আর কোনও সমস্যা হওয়ার কথা না। এখন বৃষ্টি হওয়ারও কোনও সম্ভাবনা নেই ফলে নির্ভয়ে পাহাড়ে বেড়াতে যেতে পারেন সকলে।