মাত্র ১৭ মাস বয়সের ছোট্ট অস্মিকা দাস। মিষ্টি মুখে হাসি থাকলেও শরীরের ভেতর চলছিল নীরব ধ্বংস। বিরল ও ভয়ঙ্কর জিনগত রোগ, স্পাইনাল মাসকুলার অ্যাট্রফি (SMA টাইপ-১) তার দেহকে নিঃশেষ করে দিচ্ছিল ধীরে ধীরে। অস্মিকার চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন ছিল পৃথিবীর অন্যতম ব্যয়বহুল ওষুধ, জোলজেনসমা ইনজেকশন, যার দাম ১৬ কোটি টাকা!
এই বিপুল অঙ্কের টাকা সংগ্রহ করার জন্য হাত ধরেছিল মানুষ। শুরু হয়েছিল অনলাইন ‘ক্রাউড ফান্ডিং’। ইঞ্জেকশনটির প্রথম দফার খরচ দাঁড়ায় ৯ কোটিতে। সেই বিপুল অর্থ সংগ্রহে এক হতে শুরু করেন সমাজের নানা প্রান্তের মানুষ।
আরও পড়ুন: ছুটে এল গোটা গ্রাম! প্রেমিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার চরম সীমায় স্ত্রী, ঘরে ঢুকল স্বামী
প্রায় ১১ মাস ধরে চলা এই অর্থ সংগ্রহ অভিযান অবশেষে সাফল্য পায়। কলকাতার পিয়ারলেস হাসপাতালে, শিশু চিকিৎসক ডা. সংযুক্তা দের তত্ত্বাবধানে, অবশেষে বুধবার অস্মিকাকে সেই ইনজেকশনটি দেওয়া হয়। চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, যদিও সময় কিছুটা দেরি হয়ে গেছে, তবুও এখন থেকে অস্মিকার শরীরে রোগ প্রতিরোধ শুরু হবে, এবং ধীরে ধীরে সে সুস্থতার পথে এগোবে।
এসএমএ টাইপ-১ এমন এক জিনঘটিত রোগ, যা বাবা-মায়ের জিনগত ত্রুটির কারণে সন্তানের শরীরে এসএমএ প্রোটিনের ঘাটতি ঘটায়। ফলে শিশুর পেশি এবং স্নায়ু একে একে দুর্বল হয়ে পড়ে।
ডা. সংযুক্তা দে বলছেন, “এই রোগ যত তাড়াতাড়ি ধরা পড়ে এবং ইঞ্জেকশন দেওয়া শুরু হয়, ফল তত ভাল হয়। অস্মিকাকে কিছুটা দেরিতে ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে, তাই কিছু জটিলতা থেকে যেতে পারে। তবে সে আগের থেকে অনেক ভাল থাকবে।”
তিনি আরও বলেন, “ইঞ্জেকশনের আগে অস্মিকা বসতে পারত না, খাবার গিলতেও কষ্ট হত, হাত-পা ঠিকমতো নাড়াতে পারত না। এখন আশা করছি, সে এগুলি অনেকটাই করতে পারবে।”
অস্মিকার বাবা শুভঙ্কর দাস জানান, “ওর ছ’মাস বয়সে রোগ ধরা পড়েছিল জিন টেস্টে। আমি চেয়েছিলাম বিনামূল্যে ওষুধটা পাই, কিন্তু পারিনি। এরপরই ভাবলাম, মানুষই ভরসা। শুরু করলাম ক্রাউড ফান্ডিং, যদিও প্রথম ২০-২৫ দিন এক টাকাও উঠছিল না। ধীরে ধীরে মানুষ জানতে পারল এই রোগ সম্পর্কে। আর তারপর একে একে হাজার হাজার মানুষ পাশে দাঁড়াল আমার মেয়ের জন্য।”
তবে শুধু অস্মিকা নয়, বাংলায় এই বিরল রোগে আক্রান্ত আরও শিশু রয়েছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার সোনারপুরের হৃদিকা দাস তাদেরই একজন। তার মা হৈমন্তী দাস বলেন, “আমার একটাই অনুরোধ মুখ্যমন্ত্রীর কাছে, দয়া করে আমাদের মতো মায়েদের পাশে দাঁড়ান। ৯ কোটির ওষুধ আমাদের পক্ষে কেনা সম্ভব নয়।”
আরও পড়ুন: ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতা; কালীগঞ্জে বৃষ্টির মধ্যেই চলছে ভোটগ্রহণ
এই রোগের ওষুধ ভারতে উৎপাদিত হয় না, বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। ফলে শুধু অস্মিকার মতো শিশুদের বাঁচাতে নয়, একই সঙ্গে এর খরচ নিয়েও ভাবতে হবে সরকারকে।
ডা. সংযুক্তা দে মনে করছেন, এই রোগ নিয়ে ব্যাপক সচেতনতা গড়ে তোলা দরকার। তিনি বলেন, “যদি বাবা-মায়ের জিনগত ত্রুটি আগে থেকে চিহ্নিত করা যায়, তাহলে ভবিষ্যতের সন্তানদের বাঁচানো সম্ভব। থ্যালাসেমিয়ার মতো এই রোগেরও প্রিভেন্টিভ ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।”
তিনি চান, সরকার এই রোগ নিয়ে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন শুরু করুক। কারণ, ৯ কোটির ইনজেকশন প্রতিটি শিশুকে দেওয়া অসম্ভব। কিন্তু আগেভাগে সচেতন হলে, এই রোগ প্রতিরোধ সম্ভব।
এই লড়াইয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিল এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও। সংস্থার প্রতিনিধি অনিকেত ঘোষ জানাচ্ছেন, “আজ অস্মিকার নাম সবাই জানেন। তার এই যুদ্ধে শামিল হয়ে মানুষ শুধু একটি প্রাণ নয়, একটা বার্তাও দিল, ভালবাসা ও ঐক্য থাকলে কোনও কিছুই অসম্ভব নয়।”
তিনি জানান, এখনও বাংলায় প্রায় ১০টি শিশু এই রোগে আক্রান্ত। তাদের বাঁচাতে চাই আবারও একইরকম সহানুভূতি ও সচেতনতা।
অস্মিকার এই লড়াই কেবল একটি শিশুর বেঁচে থাকার গল্প নয়। এটি একটি সমাজের গল্প, যেখানে মানুষ অচেনা এক শিশুর জন্য কোটি কোটি টাকা তুলে দেয়। এটি চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক সীমাবদ্ধতাকে জয় করার গল্প। এবং সবথেকে বড় কথা, এটি ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে সজাগ হওয়ারও এক আহ্বান।