বঙ্গদেশে বহু স্থানে কার্তিক শুক্লা নবমী তিথিতে দেবী জগদ্ধাত্রীর আরাধনা হয়ে থাকে। জগদ্ধাত্রী পুজোর ব্যাপকতা সেভাবে না থাকলেও, বা জগদ্ধাত্রীপুজো বঙ্গদেশের বাইরে একেবারেই প্রচলিত না হলেও, দেবী সাধক সমাজে অগ্রগণ্যা।
তান্ত্রিক মার্গে জগদ্ধাত্রীই হলেন সাধকের অভীষ্ট ব্রহ্মের স্বগুন রূপ। সৎ, চিৎ এবং আনন্দের সমিষ্টিই হলেন পরমব্রহ্ম। সেই পরমানন্দের সন্ধানই দেবীর রূপ রহস্য। নিবিষ্ট চিত্তে এই সন্ধান চালিয়ে গেলে, ক্রমে সাধক তার কাঙ্খিত পরমব্রহ্মের স্বরূপ জ্ঞাত হয়, উন্মোচিত হয় ব্রহ্মবিদ্যা। দেবী জগদ্ধাত্রীই সাক্ষাৎ ব্রহ্মবিদ্যা।
স্বভাবত নিরাকার রূপিনী এই দেবী এক্ষণে পরমা প্রকৃতিরূপে নিজেকে প্রকাশিত করেছেন, অতঃপর সৃষ্টি স্থিতি লয়ের মাধ্যমে অখিল জগৎ রূপে বিরাজ করছেন। ওই বিশ্বেশ্বরী বিশ্বে জীবকুল রূপে প্রকাশিত। জীব, নির্জীব, তথা তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ মনুষ্যকুল তাঁরই চূড়ান্ত বিবর্তিত প্রতিমা। মনুষ্য দেহে চৈতন্য রূপে নিরাকারা হয়ে বিরাজ করেন ও দেহরূপে সাকারা হয়ে।ওই নিরাকারা বিশ্বব্যাপিনী চৈতন্য জীবদেহে কুণ্ডলিনীরূপা মহাশক্তি। তিনিই ত্রিগুনাতীত সাধকের সন্ধানী চেতনায় ধরা দিচ্ছেন মূর্ত ব্রহ্মরূপে।
আরও পড়ুনঃ জগতের সমস্ত শক্তির উৎস; দেবী জগদ্ধাত্রী
জগদ্ধাত্রী তত্ত্ব নিয়ে অগ্রসর হওয়ার পূর্বে কামিনী তত্ত্ব সম্বন্ধে আলোচনা প্রয়োজন। সাধন বাস্তবিক এক সন্ধান। কিসের সন্ধান? স্বয়ং এবং ব্রহ্মের মধ্যে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের রহস্য উদঘাটন করাই সাধন। সন্ধান করতে হবে সেই আনন্দের, যা জীবের মধ্যেই বিরাজ করছে। যার উপস্থিতি টের পাওয়া সহজ, কিন্তু অবস্থান অতীব দুর্গম অগম্য ধামে। নিষ্কাম হওয়াও এক প্রকার কামনা, তাই কামিনী তত্ত্ব সাধকের সন্ধানের প্রথম সোপান। প্রবৃত্তিকে নিবৃত্তিতে রূপান্তরিত করাও এক কঠিন কামনা। যতক্ষণ সাধক তাঁর শক্তি বহির্মুখী থেকে অন্তর্মুখী করতে অপারগ, ততক্ষণই তিনি চিদানন্দের স্বরূপ জ্ঞাত নন।
এই বিপুল সাধনশক্তিকে কেন্দ্রীভূত করে, প্রবৃত্তিকে জয় করে, নিবৃত্তির মার্গে তাকে চালিত করে ব্রহ্মের উদ্যেশে গমনে সহায়তা করেন কুলকুন্ডলিনি কামিনী। সাধকের নিষ্কাম হওয়ার কামনা পরিপূর্ণ করেন। কামিনী আর জগদ্ধাত্রীর রূপ রহস্য একই সূত্রে বাঁধা। তফাৎ কেবল একটাই। জগদ্ধাত্রীর ক্ষেত্রে বাহন মৃগেন্দ্র করি (হস্তী) মস্তক দমন করে রেখেছে, কিন্তু কামিনী দেবীর ক্ষেত্রে সেরূপ দেখা যায় না, যথা-
“সিংহস্কন্ধসমারূঢ়াং রক্তবর্ণাং চতুর্ভূজাম।
নানালঙ্কারভূষাঢ়্যাং রক্তবস্ত্র বিভূষিতাম্।
শঙ্খ চক্র ধনুর্ব্বান বিরাজিত করাম্বুজাম্।।
কামিনীং প্রথমং ধ্যাত্বা জপ পূজাং সমাচরেৎ।।”





