বড়বাজারের হোটেলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর বৃহস্পতিবার দুপুরে ওই এলাকা পরিদর্শন করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর সঙ্গে ছিলেন দমকলমন্ত্রী সুজিত বসু, কলকাতার পুলিশ কমিশনার মনোজ বর্মাও। ওই হোটেলের আশপাশের বেশ কিছু বাড়ির অবস্থা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই প্রসঙ্গে আশপাশের কিছু বাড়ির কথাও উল্লেখ করেন মমতা। একটি বাড়ি দেখিয়ে মমতা জানান, সেটির ছাদ প্রায় ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা তৈরি হয়েছে।
এই বাড়িগুলি সংস্কারে বাসিন্দাদের সুবিধা করে দিতে পুলিশ, পুরসভা এবং দমকলকে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনুরোধ করেন মমতা। সংস্কারের সময় বাড়ির বাসিন্দারা যেন কিছু দিনের জন্য অন্যত্র থাকার সুযোগ পান, সে দিকটি দেখার জন্য বলেন তিনি। দোকানগুলিকে প্লাস্টিক বা রাসায়নিক মজুত না করার জন্য অনুরোধ করে তিনি। কথা প্রসঙ্গে মমতা বলেন, “কিছু জায়গায় অনেক প্লাস্টিক মজুত রয়েছে। কথা শোনে না। শুনতে হবে। আমি কারও বিরুদ্ধে নই। আপনারা ভাল থাকুন, আমি সেটাই চাই। এটা বলার জন্য আমাকে ভোট না-দিলে, না-দিন। চাই না। কিন্তু দয়া করে নিজেদের জীবন বাঁচান।”
আরও পড়ুন: সান্দাকফুতে তুষারপাত, বরফের পুরু চাদর সড়কপথে; উচ্ছাস পর্যটকদের
বড়বাজারে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, কোনও কোনও বাড়িতে ১০টি পরিবারও থাকে বলে তিনি জানতে পেরেছেন। মুখ্যমন্ত্রী সেখান থেকে চলে যাওয়ার পরে আশপাশের চত্বরে খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা যায়, একটি বাড়ির বাইরের দিকের দেওয়ালে লেখা, ১৯১৪ সাল। ধরে নেওয়া যেতে পারে সেটি ১৯১৪ সালে তৈরি হয়েছিল। বাড়িটির ভিতরে দোতলায় প্রচুর ছোট ছোট ঘর ঘর রয়েছে। আবার একটি ভবন তৈরি হয়েছিল ১৯১৫ সালে। সেটির নীচের তলায় বিভিন্ন দোকান রয়েছে। সেখানে কিছু মানুষ কাজও করছেন। তবে ওই দোকানের জন্য কাকে ভাড়া দেওয়া হয়, সে প্রশ্নের জবাব এল, তাঁরা সেখানে শুধুই কাজ করেন। বাকি কিছু জানেন না।
আগুন ধরে যাওয়া হোটেলটি ‘সিল’ করে দেওয়া হবে বলে জানান তিনি। দমকল যখন প্রবেশ করার চেষ্টা করছিল, তখন হোটেলের দরজা বন্ধ ছিল বলেও জানান মুখ্যমন্ত্রী। মমতা বলেন, “ইমার্জেন্সিতে সব সময় বিকল্প ব্যবস্থা রাখা উচিত। ইমার্জেন্সিতে যারা বিকল্প রাখে না, তাদের কি ক্ষমা করা উচিত? কোথাও কোথাও আমি ভীষণ টাফ। এ ব্যাপারে আমি কিন্তু রাফ অ্যান্ড টাফ!”
আরও পড়ুন: আইসিইউতে সৌগত রায়! অনুষ্ঠান মঞ্চে হঠাৎই অসুস্থ দমদমের সাংসদ
বড়বাজারের ওই অগ্নিকাণ্ডে ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাঁদের বেশির ভাগই দম বন্ধ হয়ে মারা গিয়েছেন। বস্তুত, এই দুর্ঘটনার সময় মুখ্যমন্ত্রী পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সফরে ছিলেন। কলকাতায় ফিরে বৃহস্পতিবার দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান তিনি। মমতা জানান, দিঘায় থাকাকালীনও সারা রাত তিনি পরিস্থিতির উপর নজর রেখেছিলেন। দমকলমন্ত্রী সুজিত এবং কলকাতা পুলিশের সঙ্গে অবিরাম যোগাযোগ রাখছিলেন তিনি।
আশপাশের বাড়িগুলির প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আপনাদের জমি, ঘর নিয়ে সমস্যা থাকতে পারে, বাড়ির মালিকের সঙ্গে ভাড়াটিয়ার সমস্যা থাকতে পারে। কিন্তু আপনাদের বুঝতে হবে এটি জীবন-মরণের প্রশ্ন। যদি ভাল ভাবে জীবন কাটাতে চান, তা হলে যাঁরা সশরীরে এখানে বাস করেন, তাঁদের সঙ্গে পুলিশ-পুরসভা কথা বলবে।” আইনি জটিলতা সংক্রান্ত বিষয়গুলি আদালতকেও বিবেচনা করার জন্য বলা হবে বলে আশ্বস্ত করেন তিনি।
মমতা জানান, ওই হোটেলটি ‘সিল’ করে দেওয়া হবে এবং ঘটনার তদন্তের জন্য তিনি একটি কমিটিও গঠন করে দেবেন। হোটেলের ব্যবস্থাপনা নিয়েও বেশ কিছু অভিযোগ তুলে ধরেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “এখানে একটাই সিঁড়ি ছিল। সিঁড়ি দিয়ে কেউ নামতে পারেনি। দু’জন সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে সিঁড়িতেই ‘ট্র্যাপ’ হয়ে মারা গিয়েছে।” দমকল এবং পুলিশ মই ব্যবহার করে ৯০ জনের প্রাণ বাঁচিয়েছে বলে জানান তিনি। ওই হোটেলে ধোঁয়া নির্গমনেরও ব্যবস্থা ছিল না বলে অভিযোগ মুখ্যমন্ত্রীর। তিনি বলেন, “দমকল যখন (হোটেলের ভিতরে প্রবেশের) চেষ্টা করে, তখন হোটেলের ঘর বন্ধ ছিল। আগুনে মৃত্যু হয়। ধোঁয়ায় মৃত্যু হয়েছে।” তাঁর স্পষ্ট বার্তা, হোটেল ব্যবসা করলে অতিথিদের সুরক্ষার দিকটিও দেখতে হবে হোটেল কর্তৃপক্ষকে।
তবে শুধু এই একটি এলাকা নয়, বড়বাজারে আরও বেশ কিছু এলাকা এবং জোড়াসাঁকোয় কিছু ভবন নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি। অতীতে বাম জমানায় নন্দরাম বাজার এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের প্রসঙ্গও তুলে ধরেন তিনি। মমতা জানান, তিনি তিন দিন সেখানে রাস্তায় বসেছিলেন। কিন্তু সরকারের কেউ আসেনি।
বড়বাজারের ওই অগ্নিকাণ্ডের পর শহরের বাকি এলাকায় ভবনগুলি খতিয়ে দেখতে কলকাতা পুরসভাকেও অভ্যন্তরীণ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। এর জন্য পুরসভাকে কেন্দ্রীয় ভাবে একটি তদন্তকারী দলও গঠনের নির্দেশ দেন তিনি। সেখানে মেয়র, পুরকমিশনার, কলকাতা পুলিশের কমিশনার এবং কলকাতা এলাকার সব ডিসি এবং দমকলের প্রতিনিধিরা থাকবেন। শুধু কলকাতাতেই নয়, জেলাস্তরেও এই অনুসন্ধানের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। সেখানে ওই তদন্তকারী দলে পুলিশের তরফে জেলার পুলিশ সুপার থাকবেন বলে জানান মমতা।
যে বাড়িগুলিকে ইতিমধ্যে পুরসভা নোটিস পাঠিয়েছে, সেই বাড়িগুলির বাসিন্দাদের উদ্দেশে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আগে আপনাদের জীবন বাঁচান। আপনাদের বের করে দেওয়ার কথা বলছি না। কিন্তু আপনারা যাতে ঠিক ঠাক থাকেন, (সেটাই আমরা চাই)।” পাশাপাশি পুলিশ এবং দমকলকে ‘সারপ্রাইজ় ভিজ়িট’-এর জন্যও বলেন তিনি। এই ধরনের ঘটনাগুলিতে স্থানীয় কোনও জনপ্রতিনিধি বা প্রশাসনের কেউ সাহায্য করে থাকলে, তাঁদের বিরুদ্ধেও পদক্ষেপের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি। মমতার হুঁশিয়ারি, যে রাজনৈতিক দলেরই হোন, কাউকে রেয়াত করা হবে না। বড়বাজারের ওই এলাকা পরিদর্শনের পর পার্কস্ট্রিট চত্বরেও ‘সারপ্রাইজ় ভিজ়িটে’ যান মুখ্যমন্ত্রী।