তখন সবে সবে মহিষাসুরকে বধ করেছেন দুর্গা। দেবকুলে চলছে মহোৎসব। দেবতারা ভেবেছিলেন, দুর্গা যেহেতু তাঁদেরই সম্মিলিত শক্তির প্রকাশ, তাই অসুর বধ হয়েছে তাঁদেরই যুগ্ম শক্তিতে। ব্রহ্মার বরের সম্মানরক্ষা করতে কেবল ওই নারীদেহটির প্রয়োজন ছিল। তখন ব্রহ্ম যক্ষের বেশ ধারণ করে তাঁদের সামনে উপস্থিত হলেন। দেবতাদের ওই গর্ব দেখে পরমেশ্বরী দেবী একটি তৃণখণ্ড অলক্ষ্য থেকে ছুড়ে দেন দেবতাদের দিকে। পরীক্ষা করতে চাইলেন তাঁদের শক্তি।
আরও পড়ুনঃ ধৃতি যোগের সঙ্গে শ্রবণা নক্ষত্র, সোনায় মোড়া ভাগ্য থাকবে এই চার রাশির
কিন্তু, ইন্দ্র বজ্রদ্বারা সেই তৃণটি ধ্বংস করতে ব্যর্থ হলেন। অগ্নি সেই তৃণ দহন করতে পারলেন না, বায়ু অসমর্থ হলেন তা উড়িয়ে নিয়ে যেতে। বরুণের শক্তি সেই তৃণটুকুর একটি অংশও জলস্রোতে প্লাবিত করতে পারল না। দেবতাদের এই দুরবস্থা দেখে তাঁদের সামনে আবির্ভূতা হলেন এক পরমাসুন্দরী সালঙ্কারা চতুর্ভুজা মূর্তি। তিনিই জগদ্ধাত্রী। জগদ্ধাত্রী এভাবে আবির্ভূতা হয়ে দেবতাদের জ্ঞানচক্ষুটি উন্মীলিত করলেন। বুঝিয়ে দিলেন, তিনিই এই জগতের ধারিণী শক্তি।
ইন্দ্র, অগ্নি, বায়ু ও চন্দ্র– এই চার দেবতা অহংকারে ডুবে নিজেদের ঈশ্বর মনে করতে শুরু করায়, তাঁরা বিস্মৃত হলেন যে দেবতা হলেও তাঁদের স্বতন্ত্র কোনও শক্তি নেই– মহাশক্তির শক্তিতেই তারা বলীয়ান। দেবগণের এই ভ্রান্তি দূর করার জন্য দেবী জগদ্ধাত্রী কোটি সূর্যের তেজ ও কোটি চন্দ্রের প্রভাযুক্ত এক দিব্য মূর্তিতে তাঁদের সম্মুখে উপস্থিত হন। দেবগণ নিজেদের ভুল উপলব্ধি করলেন। তখন দেবী তার তেজোরাশি স্তিমিত করে এই অনিন্দ্য মূর্তি ধারণ করলেন।
আরও পড়ুনঃ ‘মান্থা’র তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড অন্ধ্র উপকুল, বিপর্যস্ত ওড়িশা
জগদ্ধাত্রী যে দুর্গারই বিকল্প রূপ, তার প্রথম সুস্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায় শ্রীশ্রীচণ্ডীতে। সেখানে বলা আছে, যুদ্ধের সময় মত্ত মহিষাসুর নানা মায়ারূপ ধরে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছিলেন দেবীকে। একবার সেই প্রচেষ্টায় মহিষাসুর ধারণ করেন হস্তীরূপ। সেই হস্তী দেবীকে বধের চেষ্টা করলে দুর্গা ধারণ করেন এক চতুর্ভুজা মূর্তি। চক্রদ্বারা তিনি ছেদন করেন হাতির শুঁড়টি। সেই রূপটিই জগদ্ধাত্রীর। সেই জন্যই জগদ্ধাত্রীর বাহন সিংহ এক হাতির মৃত শরীরের উপর দাঁড়িয়ে। কখনও বা সেই সিংহ খেলা করে হাতির কাটা মাথা নিয়ে। সংস্কৃতে হাতির একটি নাম করী, সেই অনুসারে অসুরটির নাম করীন্দ্রাসুর। রামকৃষ্ণ পরমহংসের ভাষায়, “মন করীকে যে বশ করতে পারে তারই হৃদয়ে জগদ্ধাত্রী উদয় হন।… সিংহবাহিনীর সিংহ তাই হাতিকে জব্দ করে রেখেছে।”
করীন্দ্রাসুরের জন্ম ও বধের সামান্য ও আকর্ষণীয় বর্ণনা মেলে নন্দকুমার কবিরত্নের লেখা শ্রীশ্রীকালী কৈবল্যদায়িনী গ্রন্থে। গঙ্গা-অবতরণের সময়ে দেবী গঙ্গাকে পেতে ইচ্ছা প্রকাশ করে ইন্দ্রের বাহন ঐরাবত। গঙ্গা স্বয়ং ইন্দ্রের মায়ের সমান। তাই ইন্দ্র রেগে তাঁর বাহনকে অসুরাংশে হস্তিনীগর্ভে জন্ম নেওয়ার অভিশাপ দেন। তখন ঐরাবত কেঁদে পায়ে পড়ে গেলে ইন্দ্র বলেন,
ইন্দ্র কহে মহামায়া/ হবে জগদ্ধাত্রী কায়া/ হরি হবে তাঁহার বাহন। নখর প্রহারে তার/ তব কুম্ভ হবে দার/ মুক্ত হবে শাপেতে বরণ। ওদিকে মর্ত্যলোকে এক হস্তিনীর গর্ভে করীন্দ্রের জন্ম হয়। দিনে দিনে সে অসুররাজ দুর্গাসুরের সেনাপতি হয়। এবং দেবীর বাহন সিংহের দ্বারা বিদীর্ণকুম্ভ হয়ে শাপমুক্ত হয়। এইভাবে এই জগতের ধারণকর্ত্রী হিসেবে দেবকুলে পূজালাভ করেন দেবী জগদ্ধাত্রী।





