রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে নরেনের মাথায় চিন্তার সাগর ভাসতে থাকে। “তাহলে আমার চাকরীটা… ঘরে যেয়ে মাকে কি বলব… আর আমার বোনকে… না না … এ হতে পারে না… এ হতে পারে না। ” যখন সে বাসস্ট্যান্ডে এসে হাজির হয় তখনও তার হুশ হয়নি। পিছন থেকে একটা চেনাসুর চিন্তার মহল থেকে তাকে বাস্তবে টেনে আনে।
“এ নরেন কোথায় যাবি?”
“কে ?” পিছন ফিরে ঘুরে দাঁড়ায় নরেন।
“আমি, আমি দেশবন্ধু, চিনতে পারছিস না ?”
লোকটার দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখে তারই ক্লাসফ্রেন্ড দেশবন্ধু চক্রবর্তী। বহু বছর পর তার সাথে দেখা। মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার পর থেকেই তার সাথে নরেনের কোন যোগাযোগ হয়নি। শরীরে তার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। তাই প্রথমে নরেন চিন্তে না পারলেও দেশবন্ধু সেই পুরাতন অপরিবর্তিত চেহারার বন্ধুকে চিনতে পারে। তাই তার যাবার আগে তারই কতকগুলি কথা নরেনের কানে বাজতে থাকে।
“কোথায় যাবি?”
“বাড়ী।”
“হাতে ফাইল কি জন্য?”
“একটা চাকরীর ইনটারভিউ ছিল।”
“কোথায়?”
“এই অফিসে”, বলে হাতের ইশারায় নরেন দেখিয়ে দেয়।
“তারপর কোন কাজ হল, নরেন।”
“না ভাই, আমাদের মতো ছেলেদের জন্য ও স্থান নয়। তাই আমার ভারী চিন্তা।”
“চিন্তা করে কোন লাভ নেই ভাই। ভাগ্যের লিখন খন্ডাবে কে? চেষ্টা করে দেখ কিছু একটা হয়ে যেতে পারে। কিন্তু এখন আছিস কোথায় ?”
“সেই আস্তানায় নিকুঞ্জপুরে।”
“ঐ বাসাটা এবার ছেড়ে দে। নতুন একটা ঘর আছে ভাড়া নিবি?”
“কত ভাড়া ?”
“মাসে দুশো টাকা। তাছাড়া সবরকম ব্যবস্থা আছে। পায়খানা, বাথরুম, কুয়ো, রান্নাঘর, এছাড়া দুটো বড় বড় ঘর, সব ব্যবস্থা আছে। ”
“কিন্তু।”
“কিন্তু আর কি। ওখানে টিউশন করে ঘরভাড়া দিতে পারবি , হাতখরচ চালাতে পারবি, সংসার খরচও। যাবি ? মাসিমাকে একবার বলে দেখব?”
“কোথায়?”
“ছত্রগ্রাম।”
“এখান থেকে কতদূর?”
“বেশি দূর নয়। মাইল ষাট থেকে সত্তর হবে।”
“ঠিক আছে, মাকে বলে দেখব। কিন্তু তুই এখন কি করছিস?”
“কিছু না, বাবার ফ্যাক্টরী দেখাশুনা করছি। বলতে গেলে বেকার।” এর বেশী দেশবন্ধু’র সাথে কথা হয়নি।
বাসটা কখন এসে সমস্ত যাত্রীদের নিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরী। এরই ভিতর ভিড়ের মধ্য দিয়ে নরেন উঠতে গিয়ে রাতের ফাইলটা হাত থেকে ফসকে বাসের চাকার তলায় পড়ে যায়। বাধ্য হয়ে নামতে হয়। ফাইলটা হাতে নিয়ে আবার উঠতে যাবে এমনাবস্থায় বাসটা ছেড়ে দেয়।
হতাশ হয়ে মাথায় হাত দিয়ে বাসস্ট্যান্ডের একটা বেঞ্চিতে বসে পড়ে। আজ দিনটা তার খারাপ। নাহলে, ঘর থেকে বেরোনোর সময় তার অসুস্থ মা বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিল। এখন কেমন আছে কে জানে। আর ইন্টারভিউ হলে চাকরীর কোন সুযোগ-ই নেই আবার এইধারে বাস ফেল।
এবার বিকাল পৌনে ছ’টা ছাড়া কোন উপায় নেই। তখন যদি এমনি করে ফেল হয় তবে সারারাত এখানে তাকে কাটাতে হবে।
এখানেই শেষ নয়। গল্পটি এখন চলবে…