আমাদের শরীরের কণাগুলো পৃথিবী সৃষ্টির আগেই মহাবিশ্ব ঘুরে এসেছে। শরীর গঠনে থাকা পরমাণুগুলো শুধু তারার ভেতরেই জন্ম নেয়নি বরং তা আমাদের ছায়াপথ মিল্কিওয়ে ছাড়িয়ে মহাজাগতিক ভ্রমণে বের হয়েছিল! সাম্প্রতিক এক গবেষণায় জানা গেছে, এই কণাগুলোর অনেকগুলোই একসময় মহাবিশ্বের গভীরে হারিয়ে গিয়েছিল, তারপর আবার ফিরে এসে পৃথিবী ও প্রাণ সৃষ্টির অংশ হয়েছে। তারার ভেতরে বিস্ফোরণের মতো ঘটনাগুলোর (যেমন সুপারনোভা বা নিউট্রন স্টার সংঘর্ষ) মাধ্যমে হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের চেয়ে ভারী উপাদান—যেমন কার্বন, অক্সিজেন, আয়রন ইত্যাদি—তৈরি হয়। আগে ভাবা হতো, এসব উপাদান নিজের গ্যালাক্সিতেই থেকে যায় এবং নতুন তারা ও গ্রহ তৈরি করে।
কিন্তু এখন বিজ্ঞানীরা বলছেন, এসব উপাদান গ্যালাক্সির বাইরে ছড়িয়ে পড়ে, বিশেষ করে “সার্কামগ্যালাক্টিক মিডিয়াম” বা CGM-এ। এটা এক ধরনের গ্যাসীয় স্তর, যা গ্যালাক্সির বাইরের দিকে ছড়িয়ে থাকে। গবেষণার প্রধান লেখক সামান্থা গারজা বলেন, “তারার বিস্ফোরণে তৈরি ভারী উপাদানগুলো CGM-এ ছিটকে পড়ে, তারপর আবার সেগুলো ফিরে আসে, নতুন তারা ও গ্রহ তৈরিতে অংশ নেয়।” অর্থাৎ CGM হলো এক ধরনের মহাজাগতিক রিসাইক্লিং সিস্টেম!
এই গবেষণায় বিজ্ঞানীরা হাবল টেলিস্কোপ ব্যবহার করে দূরের ৯টি কোয়াসারের আলো বিশ্লেষণ করেছেন, যেগুলোর আলো CGM-এর মধ্য দিয়ে এসেছে। এতে তারা ১১টি তারা-উৎপাদনশীল গ্যালাক্সির আশেপাশে কার্বনের উপস্থিতি নিশ্চিত করেন। তারা দেখেন, যেসব গ্যালাক্সিতে এখনো তারা তৈরি হচ্ছে, সেখানে CGM-এ অনেক কার্বন রয়েছে। আর যেসব গ্যালাক্সি “প্যাসিভ” বা নিষ্ক্রিয়, অর্থাৎ যেখানে নতুন তারা তৈরি বন্ধ হয়ে গেছে, সেখানে এই উপাদানের উপস্থিতি অনেক কম।কার্বনের উপস্থিতি খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটা প্রাণের জন্য অপরিহার্য। গবেষকরা বলছেন, যদি কোনো গ্যালাক্সি এই উপাদান রিসাইক্লিং বন্ধ করে ফেলে, তাহলে তারা উৎপাদনও বন্ধ হয়ে যেতে পারে—অর্থাৎ সেই গ্যালাক্সি “মৃত” হয়ে যেতে পারে।
এই গবেষণার অন্যতম সদস্য জেসিকা ওয়ার্ক বলেন, “আমাদের শরীরের কার্বন হয়তো কখনো গ্যালাক্সির বাইরেই ছিল অনেকদিন।” ভাবতেই অবাক লাগে, আমরা যেসব উপাদান দিয়ে তৈরি, সেগুলোর একটা বড় অংশ বিশাল মহাবিশ্ব ঘুরে, কোটি কোটি আলোকবর্ষ পাড়ি দিয়ে, অবশেষে এখানে ফিরে এসেছে! এই আবিষ্কার আমাদের নতুন করে ভাবতে শেখায়—আমরা শুধু পৃথিবীর না, পুরো মহাবিশ্বের সন্তান। আমরা সত্যিকার অর্থেই তারার ধুলো যা কোটি কোটি বছর ধরে মহাকাশ ঘুরে জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে।