১. দেবী সরস্বতীর সৃষ্টি ও তাঁর বাহন হাঁস
দেবী সরস্বতীকে বেদ, বিদ্যা, সঙ্গীত এবং শিল্পকলার অধিষ্ঠাত্রী দেবী হিসেবে পূজিত করা হয়। পুরাণ অনুসারে, সৃষ্টির প্রারম্ভে যখন সমস্ত কিছু বিশৃঙ্খল ছিল, তখন ব্রহ্মা এই বিশৃঙ্খলা থেকে শৃঙ্খলা আনার জন্য সরস্বতীর সৃষ্টি করেন। সরস্বতীর উদ্ভবেই ব্রহ্মাণ্ডে সৃজনশীলতা, বুদ্ধি এবং শৃঙ্খলা আসে।
দেবীর বাহন হাঁস জ্ঞানের প্রতীক। হাঁসের বিশেষত্ব হলো এটি জল থেকে দুধ আলাদা করতে পারে। এটি বোঝায় যে দেবীর জ্ঞান মানুষের জীবন থেকে ভুল এবং সঠিককে আলাদা করতে সাহায্য করে।
২. বসন্ত পঞ্চমীর মিথ
সরস্বতী পুজো বসন্ত পঞ্চমীতে উদযাপিত হয়। পুরাণ অনুযায়ী, এই দিনেই সরস্বতী ব্রহ্মার বাণীতে সাড়া দিয়ে প্রথমবার মানুষের মধ্যে বুদ্ধি এবং জ্ঞান ছড়িয়ে দেন। তাই বসন্ত পঞ্চমীকে জ্ঞানের উৎসব হিসেবে পালিত করা হয়।
আরেকটি মিথ অনুসারে, এই দিন কৃষ্ণ রাধাকে হলুদ শাড়ি উপহার দেন, এবং বসন্ত উৎসবের সূচনা করেন। তাই সরস্বতী পুজোতে হলুদ রঙের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।
৩. সরস্বতী পুজো এবং বাঙালির প্রেমের গল্প
বাঙালির জীবনে সরস্বতী পুজোকে “বাঙালি ভ্যালেন্টাইন্স ডে” বলা হয়। কারণ এই দিন স্কুল-কলেজে ছাত্রছাত্রীরা প্রথাগত নিয়মের বাইরে গিয়ে সাজগোজ করে একে অপরের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করার একটি অঘোষিত সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করে। অনেক দম্পতির প্রেমের শুরুই হয় সরস্বতী পুজোর দিনে।
৪. সরস্বতী পুজোর বই আর কলম প্রণাম
সরস্বতী পুজোতে বই-খাতা, কলম দেবীর পায়ের কাছে রেখে প্রণাম করার রীতি রয়েছে। এটি শিক্ষা এবং বিদ্যার প্রতি শ্রদ্ধার প্রতীক। তবে একটি মজার গল্প হল, এই দিন বাঙালি ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষার পড়া থেকে অব্যাহতি পায়। কারণ সরস্বতী পুজোর দিনে পড়াশোনা নিষিদ্ধ, দেবীর প্রতি শ্রদ্ধা হিসেবে।
৫. সারা পৃথিবীতে সরস্বতী পূজা
ভারত ছাড়াও, সরস্বতী পুজো নেপাল, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া এবং জাপানেও উদযাপিত হয়। ইন্দোনেশিয়ার বালিতে সরস্বতী পুজোকে “হারি সরস্বতী” বলা হয়। সেদিন সেখানকার মন্দিরে বই এবং লেখার সরঞ্জাম উৎসর্গ করা হয়।
৬. দেবীর বীণা এবং সংগীতের রহস্য
সরস্বতীর বীণা শুধুমাত্র সংগীতের প্রতীক নয়, এটি জীবনের ভারসাম্যেরও প্রতীক। বীণার সাতটি তার মানুষের সাতটি আবেগকে নির্দেশ করে। সরস্বতী এই বীণার সুরের মাধ্যমে জীবনের সঠিক ভারসাম্য শিখিয়ে দেন।
৭. সরস্বতী পুজোর বিশেষ প্রসাদ
বাঙালি সরস্বতী পুজোর ভোগে খিচুড়ি, লাবড়া, পায়েস এবং নারকেলের নাড়ু থাকে। তবে পুরাণ মতে, সরস্বতী দেবী দই আর গুড় খুব পছন্দ করেন। তাই অনেক জায়গায় এই প্রসাদও নিবেদন করা হয়।
৮. সরস্বতী এবং ময়ূরের সম্পর্ক
সরস্বতীর আরেকটি বাহন হলো ময়ূর। পুরাণ অনুযায়ী, ময়ূর হল অহংকারের প্রতীক। দেবী সরস্বতী ময়ূরের উপর বসে এটিকে নির্দেশ করেন যে জ্ঞান এবং বিনম্রতা একসাথে চলতে হবে।
৯. সরস্বতী পুজোর সঙ্গীত প্রেম
সরস্বতী পুজোর দিন অনেক জায়গায় সঙ্গীত প্রতিযোগিতা হয়। পুরাণ অনুযায়ী, সরস্বতী দেবী নিজে সঙ্গীতের স্রষ্ট্রী। তিনি প্রথম ব্রহ্মাকে গায়ক এবং নটেশ্বরকে বাদ্যযন্ত্রের দায়িত্ব দিয়েছিলেন।
১০. সরস্বতীর অভিশাপ এবং শ্রীকৃষ্ণ
মহাভারতে এক কাহিনী রয়েছে, যেখানে সরস্বতী একটি যজ্ঞের সময় ক্ষুব্ধ হন এবং অভিশাপ দেন যে তার পূজা লুপ্ত হয়ে যাবে। শ্রীকৃষ্ণ সেই অভিশাপ কাটিয়ে মানুষকে সরস্বতীর পূজা শুরু করার জন্য উৎসাহ দেন। এরপর থেকেই সরস্বতী পুজো জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
সরস্বতী পুজো শুধুমাত্র জ্ঞানের উৎসব নয়, এটি বাঙালি সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং মনের গভীরে থাকা বিশ্বাসের এক বিশেষ উদযাপন।
