“নীরব পৃথিবী চায়“
সৌমেন মুখোপাধ্যায়
রাতটা নরেনের চিন্তার মধ্যেই কেটে যায়। শেষ রাতে অর্থাৎ খুব ভোর বেলায় তার ঘুমটা ধরেছিল।
প্রাত্যহিক জীবনের মতো নরেন হাতমুখ ধুয়ে গরম চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে গতদিনের ঘটনাবলী মনে করতে থাকে। সেই ইনটারভিউ- সেই বাসফেল- সেই ভদ্রলোক – ভদ্রমহিলা – তার পুরাতন বন্ধু দেশবন্ধু আর সঞ্চিতা। সঞ্চিতার কথা তাকে বেশী ভাবিয়ে তোলে।
“দাদা, এই থলিটা রইল আর এই টাকা। বাজার থেকে কিছু টাটকা শাকসব্জি, কিছু চাল, ডাল আর কিছু পারিস তো নিয়ে আসবি।”
“হাঁ ঠিক আছে।” সুনিতার হাত থেকে থলি আর কয়েকটা কাগজের নোট হাতে নিয়ে বেরিয়ে যাবে এমনসময় সুনিতা পিছন থেকে বলে, “আর ঐধারে ডাক্তারবাবুকে ডেকে আনিস। কাল থেকে মায়ের জ্বরটা বেড়েছে। ”
যা ভয় করছিল নরেন তাই হয়েছে। এইজন্য নরেন মায়ের উপর নয় নিজের উপর রাগ করতে থাকে। কিছু না বলে এবার রাস্তায় নামে।
আর পড়ুন: Weather: এ বছরের মত উধাও শীত? সংক্রান্তিতে কি আর শীত ফিরবে না কখনও!
বড় রাস্তার পাশে ডাক্তারখানাটি অবস্থিত। দরজার উপর বড় বড় অক্ষরে সাইনবোর্ডে লেখা ডাঃ এ.কে. শর্ম্মা। এম.বি.বি.এস (ক্যাল)। রোগী দেখার সময়- সকাল সাতটা থেকে বেলা দশটা আর বিকাল পাঁচটা থেকে রাত দশটা। যখন নরেন ডাক্তারখানায় গিয়ে পৌঁছায় তখন সবেমাত্র কমপাউন্ডার চেম্বার খুলে টেবিলের উপর পাদু’টো তুলে চেয়ারে হেলান দিয়ে মুখে একটা বিশাল হাই তুলে সমস্ত শরীরটাকে আরাম দিচ্ছেন। এই ঘরটি হল ডাক্তারের ঘর। যে চেয়ারটিতে কমপাউন্ডার মশায় বসে আরাম করছেন সেটাই মহামান্য এম.বি.বি.এস. করা ডাক্তারবাবুর বসার স্থান। আর তার আশেপাশে আরো খান পাঁচেক চেয়ার রহেছে। একটি বড় ক্যালেন্ডার ডাক্তারবাবুর চেয়ারের পিছনের দেওয়ালে টাঙানো আছে, তাতে কতগুলো জীবজন্তর ছবি রহেছে। এছাড়া আর একটি ঘর রহেছে সেটাতে রোগীদের বসবার ঘর। আর একটি ঘর রহেছে সেখানে শুধু ওষুধপত্র রাখা আছে। পরিস্কার, পরিচ্ছন্ন আর ছিমছাম এই ডাক্তারখানাটি।
রোগীদের বসবার ঘরে কতজন রোগীর পর নিজের জন্য একটা স্থান করে নরেন বসে পড়ে। চোখের পলক পড়তে না পড়তে হলঘরটা রোগীতে ভরে গেল, তাদের বিভিন্ন রকম সমস্যা। নরেন একবার তাদের দিকে চোখ বুলিয়ে নেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই হলঘরটা ফিসফিস শব্দে এক কোলাহলে সৃষ্টি হয় তাও আবার ক্ষণিকের জন্য, তারপর সব চুপচাপ।
ডাক্তারবাবু এসে নিজের চেয়ারে বসে প্রথম জন রোগীকে ডাকেন। প্রথম নামধারী রোগী সেই ঘর থেকে বার হয়ে ডাক্তারবাবুর চেয়ারের মুখোমুখি চেয়ারে বসেন। প্রথম রোগী দেখার পর আর একজন রোগী, এইভাবে রোগী দেখার কাজ চলতে থাকে। নরেনের যখন নম্বর আসে তখন দেওয়াল ঘড়িতে সকাল আটটা বাজে।
“ভিতরে আসতে পারি?” নরেন ভদ্রতার খাতিরে বলে।
“ইয়েস, কাম কাম।” ডাঃ এ.কে. শর্ম্মা খাতায় লিখতে লিখতে বলেন। রোগীর দিকে তাকাবার অবসরটুকুও তার নেই। ইশারায় হাত বাড়িয়ে দিয়ে সামনের খালি চেয়ারে বসতে বললেন। নরেন একটা খালি চেয়ার টেনে বসে পড়ে।
“হোয়াট ইস কেস ?” কথাটা বলে মুখটা তুললেন ডাঃ শর্ম্মা। এই একটুখানি অবসরে নরেন সমস্ত ঘটনাটি সংক্ষেপে বলে যায়, “আমার নাম নরেন, আমার মা কাল থেকে অসুস্থ ডাক্তারবাবু। দয়াকরে চলুন, নইলে আমার মা বাঁচবে না। একশ পাঁচ – দশ জ্বর, জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। চলুন ডাক্তারবাবু। মাকে বাঁচান।”
“আমার সময় নেই। দেখতেই তো পারছেন, এটা আমার চেম্বার। সব রোগী এখানে এসে চিকিৎসা করায়, তাদের জন্য আমি সেখানে গিয়ে চিকিৎসা করি না। সেটা আমার পেশা নই। তার থেকে বরং আপনি আপনার মাকে নিয়ে আসুন।”
“কিন্তু ডাক্তারবাবু, মা একটুকুও নড়তে পারেন না, বিছানাগত। তাকে কি করে এখানে নিয়ে আসবো। চলুন ডাক্তারবাবু, প্লিজ, আপনার পায়ে ধরছি।”
“আই অ্যাম স্যরি, আপনি আসতে পারেন। ”
“কিন্তু…….”
কোন কিন্তু নেই, অ্যা, ডাক্তারবাবু যা বলেছেন তাই, যান যান, খুব করে মায়ের সেবা শুশ্রুষা করুন গিয়ে”, এবার কমপাউন্ডার কথাটা বলে একগাল হেসে ডাঃ শর্ম্মার দিকে তাকান, বলেন, “ডাক্তারবাবু, এর পরেরটা ডাকবো?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয় ডাকবে, বেশী সময় নষ্ট না হয়, আমাকে আবার অন্য আর এক জায়গা যেতে হবে।”
আরও পড়ুন: Ladakh: মোদীর হাত ধরে ‘স্বপ্ন সফল’ কাশ্মীরের
কমপাউন্ডার দরজায় এসে পরের ব্যক্তিকে ডাক দেন। নরেন চেয়ার ছেড়ে উঠে দরজার দিকে পা বাড়ায়।
“অ্যাই যে মশায়, ডাক্তারবাবুর ফিস’টা দিয়ে যান।” কমপাউন্ডারের এই কথায় নরেন রেগে যায়, বলে, “কিসের ফিস? রোগী না দেখেই আপনাদের ডাক্তারবাবু ফিস নেন বুঝি?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, অতক্ষণ আপনার জন্য উনার সময় গেল তার ফিসটা লাগবে, বুঝলেন?”
“না, আমার আর বুঝার দরকার নেই। আমি চললাম, আমারও অনেক সময় নষ্ট হয়েছে তার ফিসটা ডাক্তারবাবুর কাছ থেকে নিয়ে তারপর দেবো।” রাগে গজগজ করতে করতে নরেন ডাক্তারখানা থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামে।