কুশল দাশগুপ্ত,শিলিগুড়ি
গত কয়েক বছরে বাঙালির খাদ্যতালিকায় বিরিয়ানির অবাক উত্থান। জন্মদিনে বন্ধুদের ‘ট্রিট’, অফিস পার্টি হোক বা দুর্গাপুজোয় নবমীর রাত- যে কোনও অনুষ্ঠানে হট ফেভারিট মোগল ঘরানার খাবারটি। ধীরে ধীরে বিয়ের মেনু কার্ডেও দাপট বাড়ছে। এমনকি যখন-তখন কম দামে খিদে মেটাতে বিরিয়ানি অর্ডার করেন অনেকে।
পাড়ার দোকান থেকে মাত্র আশি কিংবা বড়জোর একশো টাকা খরচ করলে গরম গরম এক প্লেট হাজির টেবিলে। সেই প্রেমে কিছুটা হলেও আঘাত হেনেছে শিলিগুড়ির কমোড-কাণ্ড। বিশ্বাসে ঘুণ ধরতে শুরু করেছিল বিরিয়ানির মাংসে পোকা পাওয়ার অভিযোগ ওঠার পর থেকে। বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, অনেকেই এখন এড়িয়ে চলছেন লাল শালু দিয়ে মোড়া হাঁড়ির সেই অমোঘ ডাক। এই পরিস্থিতিতে কিছুটা হতাশ বিরিয়ানির দোকান মালিকদের একাংশ। শুধু বিরিয়ানি নয়, ফ্রায়েড রাইস-চিকেন বা পোলাও-মাটনের কম্বোর চাহিদাও বেশ। কমোড-কাণ্ডের পর সেসব থেকেও নিজেদের দূরে সরিয়ে নিয়েছেন খাদ্যপ্রেমীরা।
বিশেষ দিনগুলোতে শুধুমাত্র পকেটের কথা চিন্তা করে যেখানে-সেখানে আর খাওয়া যাবে না, ঠিক করেছেন সুমিত দাস। এই শহরবাসীর কথায়, ‘বাঘা যতীন পার্কে যে রেস্তোরাঁকে নিয়ে বিতর্ক হল, সেখানে অনেকবার খেয়েছি আমরা। ছবিটা দেখে গা শিউরে উঠেছিল। প্রথমে বিশ্বাস করতে পারিনি, কেউ শৌচালয়ে খাবার রাখতে পারেন।’
এদিকে, অভিযুক্তদের দোষারোপ করছেন শহরের অন্য বিরিয়ানি বিক্রেতারা। প্রধাননগরের দোকানদার সুকমল পাল বললেন, ‘আগের থেকে বিক্রি সত্যিই কমেছে। সবার মনে একটা ভয় তৈরি হয়েছে। আমরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন খাবার বিক্রি করি। এখন যদিও সেটা বললে কেউ বিশ্বাস করবেন না।’ চেয়ারে বসে মাছি তাড়াচ্ছিলেন আশিঘরের ব্যবসায়ী অভিষেক সরকার। গলায় আক্ষেপের সুর, ‘এক-দুজনের ভুলের মাশুল সবাইকে গুনতে হচ্ছে।’ সুভাষপল্লির নেতাজি মোড়ের কাছে একটি রেস্তোরাঁর কর্মী রাহুল রায়ের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ওই ঘটনার পর থেকে তাঁদের ব্যবসায় প্রভাব পড়েছে। আগে গড়ে একদিনে ১০০ প্লেট বিরিয়ানি বিক্রি হত, এখন সেটা চল্লিশের নীচে নেমেছে।
কম দামে খাবার দেওয়ার প্রতিযোগিতায় যোগ্য সঙ্গ দেন ক্রেতারা। অথচ সেটা করতে গিয়ে যে স্বাস্থ্যবিধির সঙ্গে সমঝোতা করতে হয় মাঝেমধ্যে, তা এখন মানছেন অনেকে। এই যেমন সৌরভ ঘোষ। পেশায় মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ তরুণটি দুপুরে কোনওদিন নান-চিলিচিকেন বা কোনওদিন বিরিয়ানি খান। কমোডের পাশে বিরিয়ানির ছবি দেখার পর থেকে এড়িয়ে চলছেন সেসব। সৌরভের বন্ধু রাজীব সাহা অবশ্য বলছেন, ‘কম হোক, টাকা তো নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। বিনামূল্যে কাউকে খাবার দিলেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা উচিত। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রান্না, বাসি খাবার খাওয়ানো, মেয়াদ উত্তীর্ণ মশলার ব্যবহার মনুষ্যত্বের পরিচয় দেয় না। আমাদের কাজের সূত্রে দিনভর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ঘুরে বেড়াতে হয়। খেতে হয় বাইরে। কোন দোকানকে বিশ্বাস করব বলুন তো।’ ছেলের প্রিয় খাবার বিরিয়ানি। বাড়িতে বানানো ঝক্কি। সবসময় বড় রেস্তোরাঁয় গিয়ে খাওয়া সম্ভব নয়। পাড়ার মোড়ের দোকানই ভরসা স্বরূপা দে’র। আপাতত আর সেসব বাড়িতে ঢুকছে না, জানালেন স্বরূপা।
ধাক্কা লেগেছে পাড়ার দোকানেই। বড় রেস্তোরাঁর প্রতি যে বিশ্বাস এখনও অটুট, তা বোঝা গেল বর্ধমান রোডের পরিচিত একটি রেস্তোরাঁর ম্যানেজারের কথায়। সাফিক আলি বললেন, ‘আমাদের ব্যবসা ঠিকঠাক চলছে। তেমন প্রভাব পড়েনি।’
তবে মানুষের আস্থা অর্জন করতে হলে আগে দায়িত্ববান হতে হবে ব্যবসায়ীদের। এক-দু’দিনের জন্য নয়, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে সারাবছর।