সৌমেন মুখোপাধ্যায়, বাঁকুড়া:
সোনামুখী, বাঁকুড়া জেলার খুবই জনপ্রিয় স্থান। দেব-দেবীর সাথে বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিদের নাম সারা ভারতবর্ষে জড়িয়ে আছে, এমনি একটি নাম হল ঠাকুর হরনাথ ও কুসুমকুমারী। বাঁকুড়া জেলার সোনামুখীর ব্যানার্জী পাড়ায় (জগদ্ধাত্রী তলা) ব্যানার্জী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ঠাকুর হরনাথ। সময়টা ১৮৬৫ সাল, ১ লা জুলাই। পিতা জয়রাম বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতা ভগবতী সুন্দরী দেবী। ঠাকুর হরনাথের জন্মের পূর্বে ঘটে এক অলৌকিক ঘটনা। ঠাকুরের জন্মের আগে তাঁর মায়ের গর্ভে এক আলোর ঝলকানি প্রবেশ করে। তাঁর পিতা ছিলেন একজন বাঙালি ব্রাহ্মণ। তাঁর ছিল চার পুত্র ও দুই কন্যা, ঠাকুর হরনাথ ছিলেন তাঁদের মধ্যে পঞ্চম সন্তান।
পিতা জয়রামের অবস্থা প্রথমে খুব খারাপ ছিল, পরে কলকাতায় ব্যবসা করার পরে লক্ষাধিক উপার্জন হয়ে ধনী হন। জয়রাম ছিলেন শিবভক্ত, তাই তিনি বাড়ির কাছে একটা শিবমন্দির নির্মাণ করেন আর তাঁর স্ত্রী ছিলেন কৃষ্ণভক্ত। ঠাকুর হরনাথের জন্মের আগেই 1592 সালে বৃন্দাবনের মহান ঋষি মনোহরদাস ঠাকুর হরনাথের জন্ম সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন। 1863 সালে কলকাতায় থাকাকালীন জয়রামের গুটিবসন্ত হয়, সেই সময় একদিন রাতে তাঁর ঘরে দুটি ঐশ্বরিক রূপ সারা ঘরে আলোর ঝলকানি দিয়ে দেখা দেন এবং তাঁরা ঠাকুর হরনাথের জন্ম সম্পর্কে আলোচনা করেন। আলোচনার পর তাঁরা জয়রামের শরীর স্পর্শ করে অদৃশ্য হয়ে যান। অন্যদিকে, হরনাথের জন্মের কয়েক সপ্তাহ আগে হিমালয়ের অমরনাথ থেকে এক সাধু এসে ভগবতী দেবীর হাতে তৈরী সকালের লুচি আর ডাল খেয়ে শিবমন্দিরে প্রবেশ করেন। আর সেখান থেকেই তিনি অদৃশ্য হয়ে যান। তিনি জয়রামকে রাতে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলেছিলেন, “আপনার স্ত্রীর আন্তরিক অভ্যর্থনায় আমি সন্তুষ্ট। তাকে বলবেন আমি সর্বদা তার সাথে আছি।”
আরও পড়ুন: ছাত্র সংসদ নির্বাচন! এক অভিনব নজির সৃষ্টি
হরনাথ ছিলেন সুন্দর দেখতে, গায়ের রং কালো, প্রশান্ত ও উজ্জ্বল। তিনি ঘন ঘন কাঁদতেন বলে তাঁর মা ঈশ্বরের নাম শুনিয়ে শান্ত করাতেন। পাঁচ বছর বয়সে তাঁর মা সোনামুখীর ইস্কুলে ভর্তির সময় শিক্ষাগুরুকে বলেন যে তাকে “রাধা-গোবিন্দ” বানান শেখাতে। ঈশ্বরের প্রতি অসীম ভক্তির ফলে ছয় বছরে বড় ভক্তে পরিণত হন। প্রভুর নাম প্রচারের জন্য একটি সমিতি তৈরী হলে সেখানে তিনি নেতা হন। এটা “হরি-সেবা” নামে পরিচিত হয় যাতে তরুণ থেকে বৃদ্ধ, শিক্ষিত ও অশিক্ষিত সবাই যোগ দেন। ঈশ্বর প্রেম এর সাথে হরনাথ ভালো বক্তাও ছিলেন।
১৮৮০ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চূড়ান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন, পরে উচ্চ শ্রেণীতে পড়াশোনার জন্য কুচিয়াকোলের রাধা-বল্লভ পাঠশালায় যান। 1885 সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। উচ্চ শিক্ষার জন্য বর্ধমান কলেজে যান এবং এফ.এ. পাস করেন।
হরনাথের বিয়ে হয় মাত্র তেরো বছর বয়সে তাঁর পিতামাতার মহান বন্ধু সোনামুখীর শ্রী কন্দর্পা নারায়ণের কন্যা কুসুমকুর্ণারী (কুসুমকুমারী) দেবীর সাথে। কুসুমকুমারী ছিলেন হরনাথের ছোটবেলা থেকেই খেলার সাথী।
১৮৯২ সালে কর্মসূত্রে কাশ্মীরে যান। সেখানেও ভগবান কৃষ্ণের প্রতি অশেষ প্রেম প্রকাশিত হয়। কাশ্মীরে থাকাকালীন সবাই তাঁকে “ঠাকুর” বলে ডাকতেন, তখন থেকেই নাম হয় “ঠাকুর হরনাথ “। অটল বিহারী নন্দী, হাতরাস স্টেশনের বুকিং কেরানী ছিলেন ঠাকুর হরনাথের প্রথম ভক্ত।
১৮৯৬ সালে এপ্রিল মাসে, তাঁর জীবনে ঘটে এক অলৌকিক ঘটনা। সে সময় তিনি ভাড়া করা টোঙ্গায় করে জম্মু থেকে শ্রীনগর ফিরছিলেন। টোঙ্গায় পা রাখার সাথে সাথে তিনি অজ্ঞান হয়ে শুয়ে পড়েন। তখন বিকাল 3 টে। তখন তার শারীরিক শরীর অপ্রকৃততে পরিণত হয়, মন ও আত্মা একে অপরের সাথে মিশে যায়। সকলে তাঁকে মৃত মনে করে টোঙ্গায় করে বাড়ী নিয়ে আসে। তার সঙ্গী মৃতদেহ পারাড়া দিচ্ছিলেন। গভীর রাতে সঙ্গীটি দেখেন, মৃতদেহ এবং কিছু অদৃশ্য সত্তার মধ্যে কথাবার্তা। সঙ্গী তাই দেখে ভীত হয়ে যান। তারপর হরনাথের শরীর উজ্জ্বল হয়ে উঠে, শরীরের রং কালো থেকে ফর্সা হয়ে যায়। তিনি জীবিত হয়ে যান। হরনাথকে জীবিত দেখে আনন্দিত হয়ে সঙ্গী আবার যাত্রা শুরু করেন।
আরও পড়ুন: আজ ১৯ মার্চ, সাফল্যের উন্নতি এই চার রাশির
ঠাকুর হরনাথ কুড়ি বছর কাশ্মীরে কাটিয়েছেন। তাঁর শত শত ভক্ত চিঠিপত্র দিয়ে তাঁকে সম্মানের সাথে নিমন্ত্রণ করতেন এবং ঠাকুর সেখানে গিয়ে তাদের সমস্যার সমাধান করতেন, আবার অনেক ভক্তের কঠিন রোগ তিনি নিজ শরীরে ধারণ করে তাদের সুস্থ করে তুলতেন। কেউ কেউ ভক্ত চিঠিপত্রের মাধ্যমেই তাদের সমস্যার সমাধান করে নিতেন। ঠাকুর চিঠির মাধ্যমে সতর্ক ও নির্দেশ দিয়ে ভক্তদের বিভিন্ন বিপদ থেকে রক্ষা করতেন। ১৯১৪ সালে তিনি রাষ্ট্রীয় চাকরি থেকে অবসর নিয়ে একজন অবৈধ পেনশনভোগীতে পরিণত হন। তাঁর নামে বিভিন্ন জায়গাতে ব্যক্তিগত ও সরকারি আশ্রম গড়ে উঠে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে আবেগপূর্ণ সংকীর্তনের মাধ্যমে সমস্ত ভক্তদের মাঝে ঈশ্বরের প্রতি প্রেম নিবেদন করেছেন।
১৯২৭ সালে, ২৫ শে মে বুধবার, রাত ৯ টায়, তিনি তার নশ্বর দেহ ত্যাগ করেন, তাঁর স্ত্রী কুসুমকুমারী দেবী, দুই পুত্র- অনুকূল চন্দ্র ব্যানার্জী ও কৃষ্ণদাস ব্যানার্জী এবং তাদের স্ত্রী- সন্তান এবং তাঁর ভক্তদের মধ্যে এক গভীর ব্যথা- বেদনা- দুঃখ দিয়ে চলে যান।