রাহুল গান্ধী তো বটেই, কংগ্রেসের দলগতভাবে অভিযোগ করে থাকে ভারতে সবচেয়ে বিপন্ন ধর্মনিরপেক্ষতা। নরেন্দ্র মোদীর সরকার সংবিধানের এই মূল ঘোষণার উপর পদে পদে বুলডোজার চালাচ্ছে। সদ্য পাশ হওয়া ওয়াকফ আইন নিয়ে বিতর্কেও কংগ্রেসের সাংসদদের মুখে ধর্মনিরপেক্ষতার বিপন্নতার কথা শোনা গিয়েছে। রাহুলের ‘ভারত জোড়ো’ যাত্রাও ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষার লড়াই।
আরও পড়ুন: থমথমে জঙ্গিপুর! ৫ জনের বেশি জমায়েতে ‘না’, বন্ধ ইন্টারনেট; কড়া প্রশাসন
সেই কংগ্রেস কি ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটির ব্যবহার কমিয়ে দিতে চাইছে? আমদাবাদে শুরু হওয়ার অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটি বা এআইসিসি-র অধিবেশনে পেশ হওয়া খসড়া প্রস্তাবে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা একপ্রকার নেই বললেই চলে। পরিবর্তে দলিলে ঘন ঘন ব্যবহার করা হয়েছে জাতীয় সংহতি শব্দটি। আছে ‘জাতীয়তাবাদ’ শব্দটিও। এই শব্দটি কংগ্রেসের মূল ঘোষণাপত্রে থাকলেও হাত শিবির একদিন মূলত ধর্মনিরপেক্ষতাকেই সবচেয়ে বেশি হাতিয়ার করেছে দলের অবস্থান বোঝাতে।
অন্যদিকে, বিজেপি বারে বারেই সংবিধানে উল্লেখিত ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাখ্যাকে ছদ্ম ধর্মনিরপেক্ষতা বলে দাবি করে আসছে। পদ্মশিবিরের বক্তব্য, ভারতের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার সে ভাবনা তুলে ধরা হয়েছে তা আসলে পশ্চিমী ধারণা। যার সঙ্গে নাস্তিকতা বা ধর্ম অবিশ্বাসের কোনও ফারাক নেই। বিজেপির ওই বক্তব্যের সঙ্গে কংগ্রেসের অভ্যন্তরে অনেকেই সহমত। তাঁদের বক্তব্য, ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দ থেকে ভুল ধারণা তৈরি হয়েছে যে কংগ্রেস কমিউনিস্টদের মতো ধর্ম অবিশ্বাসী এবং হিন্দু বিরোধী । সনিয়া গান্ধী, মল্লিকার্জুন খাড়্গে, রাহুল গান্ধীরা এই অভিমতের সঙ্গে অনেকটাই সহমত হলে জানা যাচ্ছে। খসড়া প্রস্তাব তৈরির দায়িত্বে ছিলেন গান্ধী পরিবারের ঘনিষ্ঠ নেতা ছত্তিসগড়ের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ভূপেস বাঘেল।
১৯৫০ সংবিধান চালুর সময় মূল ঘোষণায় ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি ছিল না। যদিও সংবিধানের মূল ভাবনার মধ্যে তা ছিল। ১৯৭৬-এ ইন্দিরা গান্ধীর সরকার সংবিধান সংশোধন করে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি সংবিধানের মূল ঘোষণাপত্রে যুক্ত করে। আমদাবাদের খসড়া প্রস্তাবে ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে কংগ্রেস একাধিকবার ‘জাতীয় সংহতি’ শব্দটি ব্যবহার করেছে। হাত শিবির এই শব্দটিকে সামনে এনে জাত ধর্ম নির্বিশেয়ে সকলের পাশে থাকার বার্তা দিতে চাইছে। অন্যদিকে, ‘জাতীয়তাবাদ’-কে হাতিয়ার করে বিজেপির বিরুদ্ধে ছদ্ম জাতীয়তাবাদ, ছদ্ম দেশপ্রেমের অভিযোগে প্রচার জোরদার করতে চায় কংগ্রেস।
আরও পড়ুন: ‘স্বেচ্ছাশ্রমে’ নারাজ; মমতার পরামর্শ মানলেন না চাকরিহারা শিক্ষকশিক্ষিকারা
খসড়া প্রস্তাবে সমাজের পশ্চাৎপদ শ্রেণি-সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষনের কোটা বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরি, শিক্ষাতেও পিছিয়ে থাকা সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষণ চালুর দাবি তুলেছে কংগ্রেস। সদ্য মাদুরাইয়ে অনুষ্ঠিত সিপিএমের পার্টি কংগ্রেসেরও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরি, শিক্ষায় কোটা চালুর পক্ষে প্রস্তাব নেওয়া হয়েছে। কংগ্রেস সুত্রে খবর, বৈঠকে রাহুল গান্ধী সামাজিক ন্যায়ের আন্দোলনের পক্ষে ফের জোরদার সওয়াল করেন। তিনি বলেন, অতীতে দল ভুল করেছে। কংগ্রেসের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া অংশকে ফেরাতে হলে হলে সামাজিক ন্যায়ের আন্দোলনকে জোরদার করতে হবে।
তাৎপর্যপূর্ণ হল, এই ব্যাপারেও কংগ্রেস অতীতের অবস্থান থেকে সরে আসার ইঙ্গিত দিয়েছে। ১৯৮০ সালে মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ জমা হওয়ার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, পরে তাঁর পুত্র রাজীব কমিশনের রিপোর্ট কার্যকর করেননি। ১৯৯০-এ তাৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনাথপ্রতাপ সিং মণ্ডল কমিশনের রিপোর্ট মেনে অন্যান্য অনুন্নত শ্রেণি বা ওবিসি-দের জন্য সরকারি চাকরি ও শিক্ষায় ২৭ শতাংশ পদ/আসন সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নেন। যদিও সেই প্রস্তাব কার্যকর করার আগেই তিনি ক্ষমতা হারান। ১৯৯৩ সালে নরসিংহ রাওয়ের সরকার সেই প্রস্তাব কার্যকর করে। যদিও তারপরও কংগ্রেসের অভ্যন্তরে ওবিসি প্রশ্নে দ্বিধাদ্ন্দ্ব ছিল। দলের একাংশের বক্তব্য, এরফলে উচ্চবর্ণের হিন্দু ভোট হাতছাড়া হয়ে বিজেপির দিকে চলে গিয়েছে। রাহুলের বক্তব্য, বিজেপি ওবিসি ভোটব্যাঙ্কেও বড় ধরনের ধাবা বসিয়েছে। আঞ্চলিক দলগুলিও ওবিসি ভোটব্যাঙ্ককে আশ্রয় করে টিকে আছে।